শপথ রক্ষা
✍️তমা কর্মকার✍️
সময়টা আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের আমার শোনা একটা ঘটনা|আজ তোমাদের বলছি, তখন আমি চাকরি করি কলকাতার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে |ওখানেই আমার সাথে চাকরি করতো নিলাক্ষি |এই ঘটনা ওরই মামার জীবনের একটা মর্মান্তিক ঘটনা |ওর মামার নাম নির্মল রায় |বাড়ী বিরাটিতে |নির্মল রায় রেলের একজন পাকা ড্রাইভার |এক ছেলে ও বৌ কে নিয়ে নির্মল বাবুর সুখের সংসার |নির্মল বাবু প্রোমোশনের পর প্রমোশন পেয়ে উচ্চ পদোন্নতি করেছেন |একমাত্র ছেলে দার্জিলিংয়ে কনভেন্টে থেকে পড়া শুনা করে | নির্মল বাবু আজ লাস্ট ট্রেন নিয়ে বেড়িয়েছেন |আজকের এই ট্রেন চালানোই তার জীবনের শেষ ট্রেন চালানো |কেননা আগামী কাল নির্মল বাবুর রিটায়ারমেন্ট |তাই এতো দিনের চাকরি থেকে কাল অবসর পাবেন সেটা মাঝে মাঝেই মনের কোনে উঁকি মারছে| আর অজানা একটা কষ্ট ও লাগছে | আবার অবসরের পর ছেলে বৌ কে সারাটা সময় দিতে পারবে সেটা ভেবে আনন্দ ও হচ্ছিলো |তাই ট্রেন চালাতে চালাতে মাঝে মাঝেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন |দূর পাল্লার ট্রেনের গতি একটু বেশিই থাকে |তবুও আজ যেন আরো একটু গতি বেড়ে গেলো | আজ লাস্ট ডিউটি টা পড়েছে শিয়াল দহ টু নিউ জলপাই গুড়ি |ট্রেনের নাম পদাতিক, নির্মল বাবু কষ্ট আনন্দ উৎকণ্ঠায় ট্রেন চালাচ্ছেন, এইতো আর একটু খানি কুঁড়িমিনিটের পথ, তারপরই চাকরি জীবনের অবসান |ট্রেন টা নিউ জলপাই গুড়ি স্টেশনে ঢুকবে আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে |কুয়াশায় এখনো ভোরের আলো সেভাবে ফোটে নি| ট্রেনের আলোয় একি লাইনের উপর কাকে দেখতে পাচ্ছেন এযে তার একমাত্র ছেলে নীলাদ্রি দাঁড়ানো |বাবাকে হাত দেখাচ্ছে ট্রেন থামানোর জন্য |নির্মল বাবু চেষ্টা করলেন ট্রেনের গতি কমাতে, না শেষ রক্ষা হলো না |ভোরের ট্রেন নীলাদ্রির শরীর টা পিষে দিয়ে নিউ জলপাই গুড়ি স্টেশনে এসে থামলো |নির্মল বাবু নির্বিকার হয়ে ট্রেন থেকে নেমে ধীর পায়ে সোজা অফিস রুমে হেঁটে গেলেন |এবং তার চাকরি জীবনের সমস্ত কিছু জমা দিলেন| আর নিজেই নিজের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ দায়ের করলেন| তার চাকরি জীবনে এমন মর্মান্তিক একটা প্রথম ও শেষ দুরঘটনা ঘটানোর জন্য |আর নির্মল বাবু তার নিজের স্বীকার উক্তিও দিয়ে আসলেন| এই বলে যে, আজ যদি আমি জোরে ব্রেককষে ট্রেন টিকে থামাতাম তা হলে হয়তো আমার একমাত্র ছেলে নীলাদ্রি প্রাণে বেঁচে যেত | কিন্তু তাতে ট্রেন দুর্ঘটনা হতো |আর তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত | তাই আমার একটা নীলাদ্রির জন্য, হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিতে পারিনি| আমি যে ট্রেন ড্রাইভারের ডিউটি নেবার সময় শপথ নিয়ে ছিলাম |যে যে কোনো মূল্যেই আমি আমার ট্রেনের যাত্রীর প্রাণ বাঁচাবো |তাই আমি আমার শপথ রক্ষা করলাম |হয়তো আমার স্ত্রী আমায় ভুল বুঝবেন| অথবা আমার সন্তান নীলাদ্রির মা আমায় কোনো দিন ও ক্ষমা করতে পারবেন না |তবুও আমি আমার শপথ পালন করেছি |নির্মল বাবু রেলের ও জিআরপির সমস্ত কাজ মিটিয়ে, মৃত পুত্রের দেহ নিয়ে বাড়ী ফিরে এলেন |
**তমা **