“সরস্বতী পূজার সেই দিনটা”
✍️চন্দন চক্রবর্তী✍️
কনকলতার হাসি পাচ্ছে ? এই মাত্র ঈপ্সিতা বৌমার বেনারসি পরে গটগট করে বেরিয়ে গেল । না সে জন্য হাসি নয় । এতে হাসির কি আছে ! হাসি পাচ্ছে অন্য কারনে ।
সে দিনও সরস্বতী পূজা ছিল । সে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে হবে । কনকলতাও ওই দিন মায়ের একটা সিল্ক শাড়ি পরে স্কুলে গিয়েছিল ।
ক্লাস টেনের ব্যাচেরা সেবার পাস আউট। কাজেই দায়িত্ব সব নাইনের ছেলে মেয়েদের ছিল । কদিন ধরে কনকদের তাই নাওয়া খাওয়া বন্ধ হবার জোগাড় । মণ্ডপ সাজানো,পূজার আয়োজন ছাড়াও সন্ধ্যায় গান বাজনার আসর আছে,গত এক মাস ধরে ছেলে মেয়েরা মিলে নাটক করবে তার প্রস্তুতিও নিতে হয়েছে । শম্ভু স্যার,সাবিতাদি ওদের পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন । কনক আর সৌমেন মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলো । সৌমেন যদিও ওর ব্যাচ মেট । আলাপটা কিন্তু এখানেই । আসলে স্কুলটাতো সকালে মেয়েদের আর দুপুরে ছেলেদের ।
ছুটির পর গেট দিয়ে বেরনোর সময় অনেক ছেলেকেই কনকরা দেখে । উঁচু ক্লাসের অনেক ছেলেই,মেয়েদের ক্লাস ছুটি হওয়ার আগেই এসে দাঁড়িয়ে থাকে । না সৌমেনকে এর আগে কনক কোনদিন দেখেনি । শুনেছে ছেলেটা নাকি ফার্স্ট হয়,ভালো খেলে আবৃত্তি করে ।
তাতেকি ! কনকও পড়াশুনা গান বাজনার কম নাকি ! তবে সৌমেনকে দেখলে কনকের কেমন যেন লাগে,সেটা ভালো না খারাপ কনক বুজতে পারে না । রিহার্সাল চলা কালীন সৌমেনটা দেরি করলে কেমন যেন হাস ফাঁস করে,খালি দরজার দিকে চোখটা চলে যায়,সেটাও ঠিক । তাই বলে এতো দূর !
পুজোর দিন কনক সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল । একটু দূরে একটা মোড় ঘুরে স্কুলে যাবার রাস্তায় পড়তেই কনকের সাথে ওইদিন সৌমেনের দেখা হয়ে গেল । সৌমেনকে দেখে কনক কিন্তু অবাকই হল । এই রাস্তায়তো কোনদিন ওকে আগে দেখে নি ! হঠাৎ ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় যেন তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলো । ঘটনার আকস্মিকতায় কনক কেমন বেসামাল হয়ে পড়েছিল ! সম্বিৎ ফিরতে কনক এক ঝটকায় হাতটা ছড়িয়ে নিল । লজ্জায়,ভয়ে,ঘাম দিয়ে কনকের মাথায় রক্ত উঠে গেল । নিজেও জানেনা কখন ডান হাতটা তুলে একটা চাটি সাটিয়েছে ! চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো । না ভাগ্গ্যিস আসে পাশে কেউ দেখেনি ।
এরপর কনক স্কুলে গেছে,সন্ধ্যায় গান গেয়েছে,নাটক করেছে । না কোনটাতেই মন বসাতে পারেনি । গলা সারাক্ষন কেঁপেছে,নাটকও কি ভাবে শেষ করেছে তা ওই জানে । খালি মনে হয়েছে ওর হাতটা ধরি । ওর কাছে ক্ষমা চাই । না কনক পারেনি ।
না এরপর থেকে কনকের জীবনে যা যা ঘটেছে সব গতানুগতিক ! এমএবিটি করে শিক্ষকতা করেছে । বিয়ে হয়েছিল এক বেশি বয়সের বড় চাকুরের সাথে । এক ছেলের বিয়ে দিয়েছে । বৌমা মেয়ে ভালো । ঈপ্সিতা ওদের একটাই মেয়ে ।
না কনকের উত্থান পতনহীন জীবনে কোন উন্মাদনা নেই,ছিল ও না ! কেন কে জানে খালি মনে হয় কনকের জীবনটা মিছি মিছি বয়ে গেছে !
আর তখনই কানে বাজতে থাকে সেই গলার সেই তিনটে শব্দ । এখনও কি মধুরই না লাগে । বিড়বিড় করে কনকলতা এখনও আওড়ায় ! সারাজীবনেও এমনকথা কনক আর শোনেনি । কিন্তু কি ভূত চেপে ছিল কে জানে । নইলে ভালোতো লেগেছিলো,তাহলে সৌমেনকে চাটিটা মারলো কেন ! দূর ছাই চোখে আবার জল গড়াচ্ছে । “আমি তোমাকে ভালোবাসি “। হা হা হা হাসি পাচ্ছে ! কথা কটার কি মানে ! ভালোবাসা না ছাই । নইলে একটা চাটি খেয়েই সরে পরে ! কনক কাপড়ের খুটে চোখটা মুছলো ।