Spread the love

 আরতি

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

দুয়ারে সরকার, দুয়ারে সরকার করে চারিদিকে রৈ রৈ রব। যেন বাতাসে ম ম গন্ধ। সকাল থেকেই আজ আম্বেদকর পার্কে বিধবাদের ভিঁড় পড়েছে বিধবা ভাতার দরখাস্ত জমা দেবার। পাশেই টালির ছাউনির বারান্দায় বসে আরতি ঠোঙা বাঁধছে। তার বাচ্চাছেলে অসীম ক্লাস থ্রীতে পড়ে। স্কুলে চলে গেছে। এক বছরও হয়নি এখনো, করোনা ওর স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে। সে-ই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম এই সংসারে। ২৭ বছর বয়সেই আরতি বিধবা। তবুও অটুট মনোবল। বাচ্চাটাকে নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছে। সম্পদ বলতে একটা সেলাই মেসিন, নিজের দুটো হাত, আর দশকাঠা ভিটে বাড়ী। তাতে শাকসব্জি করে। কপিলদ্দি চাচা দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী প্রতিবেশী। সামান্য পয়সা নিয়ে সে আরতির ঐ খেতটায় ঘাস মারে, পরিচর্যা করে, জল দেয়, সার দেয়, নিজের মতো করে। দলে দলে বিধবারা পার্কে ভাতার দরখাস্ত জমা দিতে জড়ো হচ্ছে দেখে চাচা বলে উঠলো–

–মা জানো, দেখতিছি গরীব মহৎ সব বাড়ীর বিধবারা ভিড় জোমাচ্ছে ভাতার জন্যি উকেনে। তা তুমি গেলে না?

–না চাচা, আমি যাবো না।

–কেন মা, এতো ভোটবাবুরা বলতেছে যে সব বিধবারা এই টাকা পাবে? তাহলি তুমি যাবা না কেন মা?

–আমি তো ওই জন্যই যাবো না চাচা।

–তার মানে মা?

–চাচা। এ ভাতা সবার জন্য নয়। কেবল যারা খুব অসহায় বিধবা তাদের জন্য।

–তা তুমি কি মা সেই দলে পড়ো না? তুমি না পড়লি তো এই গাঁয়ের কেউ ওই দলে পড়বে না মা। 

একটু চুপ করে থেকে ম্লান মুখে আরতি বললো–চাচা, আমার হয়তো কপাল মন্দ। তাই আজ আমি সত্যিই খুব অসহায়; তুমি ঠিকই বলেছো যে আমি এ গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে অসহায়। তবু আমি যাবো না।

–কেন মা? একটু থেমে কপিলদ্দি চাচা বলল–

জানি মা, তুমি খুব বড় ঘরের মেয়ে। কলেজে পড়তি পড়তি বাড়ীর অমতে খোকাবাবুকে তুমি বিয়ে করেছিলে। আল্লার দোয়ায় খুব সুখেই ছিলে। করোনা আসরাইল এলো। খোকাবাবুর কারখানা বন্ধ হোল: সংসারে এলো তোমাদের টানাটানি। তারপর আল্লা তোমার সব কেড়ে নিলে। শাখা বেড়ে গেল তোমার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ বলল–

–মা আমি বলি কি, সম্মানের দিকে না তাকিয়ে নিজের বাচ্চার মুখির দিকি চেইয়ে ভাতাটা নিতে দরখাস্ত জোমা দিতে যাও। কত বড় ঘরের মেয়ে তুমি, কতবড় অফিসারের বৌ তুমি, এ নিয়ে ভেবো না মা। দেখো না, তিনতালা বাড়ীর বৌরাও লাইনে দাড়িয়েছে। ভোটবাবুদের খেলায় ওরা সবাই ভাতা পেয়ে যাবে। তুমি কেন নেবে না মা? তুমি যাও মা। এটা তোমার হক। 

–চাচা, আমি তো ওই জন্যই নেবো না।

–ঠিক বুঝলাম না মা।

–দেখ চাচা, বিধবা ভাতা সব বিধবার জন্য নয়। একেবারে এতিম সহায় সম্বলহীন বিধবাদের জন্য। কিন্তু, লাইনে দেখছো তো, এটা হোল ভোট কুড়ানোর একটা কলকাঠি। দেশের অর্থ ধ্বংস করে গরীব বড়লোক সব বিধবাদের এটা দেওয়া হচ্ছে ভোটের বাক্স ভরাতে।

–সেটা ঠিক কোথা মা। কিন্তু, তুমি না নিলি তো তুমিই ঠকপা মা।

–না চাচা, আমি ঠকছি না, আমি ঠোকবো না। যে সব বিধবারা অন্যায়ভাবে এটা নিচ্ছে, তারাই ঠকছে, তারা নিজেদের সন্তানদেরকে ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে ঠকাচ্ছে চাচা। তুমি বলো তো। এইভাবে অর্থ অপচয় হলে আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরি-বাকরির জন্য অর্থ আসবে কোত্থেকে? পাঁচশ-হাজার টাকা মাসিক ভিক্ষে নিয়ে সরকারের সামনে আমাদের বোবা হয়ে থাকতে হবে। কাশীধামের ভিখিরি হয়ে বা আজমীর শরিফের ফকির হয়ে থাকতে হবে।

–হক কথা বলেছো মা। কিন্তু তুমি যে মা বড়ো একা। কি করে জাগাবে এই ভেঁড়ীর পালকে?

–চাচা, আজ আমি একা বটে, কিন্তু দোকা হতে সময় লাগে না।

একটু থেমে আরতি বলে–তাছাড়া একটা বার্তা যাওয়া দরকার ভোটবাবুদের কাছে–ভেঁড়ীর পালের গাঁয়ে একটা সিংহীও আছে। তার হুঙ্কারে একদিন অনেককেই ছুটে পালাতে হবে। ভাতা না নিয়ে আমি সেই নীরব হুঙ্কারটা দেবো।

বুড়ো কপিলদ্দি চাচা আর কথা বাড়ায় না। আপনমনে সে কাজ করে চলে। পাঠশালা পর্যন্ত তার পড়াশুনো। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই অসামান্য তার দুটো জিনিষ–যেমন স্মৃতি শক্তি, তেমনি গানের গলা। সামনেই শারদীয়া। এই পার্কে বিরাট দুর্গাপূজো হয়। প্রতিমা গড়া চলছে। চাচা ভরাট গলায় গান ধোরলো তার আরতি মাকে লক্ষ্য করে–

খড়ের প্রতিমা পুজিস রে তোরা

মাকে তো তোরা পূজিস নে

প্রতিমার মাঝে প্রতি মা বিরাজে

হায়রে অন্ধ বুঝিস নে,

মাকে তো তোরা পূজিস নে।

দাওয়ায় বসে কাগজ কাটতে কাটতে বাংলায় এম. এ. বি এড আরতি দাশ সেই হৃদয় মন্থন করা নজরুলগীতি শোনে: সে ভেবে পায় না, কেন হঠাৎ তার সত্তরোর্দ্ধ বুড়ো ছেলে এই গান গাইছে। 

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *