★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★
——– কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– 20
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
।। জয়দ্রথ বধ পর্বাধ্যায়।।
★চতুর্দশ দিনের যুদ্ধ★
১১। জয়দ্রথের অভিমুখে কৃষ্ণার্জুন।
প্রভাত কালেতে দ্রোণ কন জয়দ্রথে।
পশ্চাতে রহিবে মোর ছ’ ক্রোশ তফাতে।।
রহিয়া পশ্চাতে তুমি করিবে গমন।
রক্ষিবে তোমায় সব মহারথগণ।।
রহিবে তোমার সাথে কর্ণ অশ্বত্থামা।
বৃষসেন ভূরিশ্রবা আর শল্য মামা।।
তারপর রচিলেন চক্রশকট ব্যূহ।
পশ্চাতে ‘পদ্ম’ নামক এক গর্ভব্যূহ।।
তারি মাঝে সূচি ব্যূহ হইল নির্মিত।
কৃতবর্মা ব্যূহ অগ্রে হইলেন স্থিত।।
জয়দ্রথ সেনা দ্বারা রহেন বেষ্টিত।
চক্রশকট ব্যূহাগ্র দ্রোণের রক্ষিত।।
পাণ্ডুসেনা ব্যূহবদ্ধ হইল যখন,
অর্জুন, সারথি কৃষ্ণে কহেন তখন,
“স্থিত যেথা কুরুভ্রাতা দুষ্ট দুর্মর্ষণ,
ত্বরা সেথা রথ মোর করহ চালন।।
গজসেনা আজ আমি করিব নিকেশ।
শত্রুসেনা ব্যূহ মাঝে করিব প্রবেশ”।।
দুর্মর্ষণে অর্জুন করেন পীড়ণ।
রক্ষিতে তারে তথায় এলেন দুঃশাসন।।
অর্জুন-শরেতে ভীত হয়ে অতিশয়,
দুঃশাসন দ্রোণ পাশে নিলেন আশ্রয়।।
দুঃশাসন-সেনা পার্থ করেন হনন।
তারপরে দ্রোণ পাশে করেন গমন।।
কৃষ্ণ অনুমতি লয়ে অর্জুন তখন,
কৃতাঞ্জলিপুটে তিনি গুরু দ্রোণে কন,
“আশীর্বাদ দিন মোরে হে ভগবন।
পারি যেন এই ব্যূহ করিতে ভেদন।।
পিতৃতুল্য গুরুজন অতি মাননীয়।
অশ্বত্থামা তুল্য আমি তাই রক্ষণীয়।।
রক্ষা যেন হয় মোর আজি এই পণ।
পারি যেন জয়দ্রথে করিতে হনন”।।
মৃদু হাসি হেসে দ্রোণ কহেন তখন।
“অগ্রে জয় মোরে তুমি করহ এখন।।
তারপর রক্ষিবারে আজি তব পণ,
চেষ্টা কর জয়দ্রথে করিতে নিধন”।।
“আচার্য আপনি মোর”, পার্থের বচন।
“করিলেও যুদ্ধ তবু শত্রু কভু নন।।
আপনার পরাক্রম জানে সর্বজনে।
জিনিবারে আপনারে কে আছে ভুবনে”!!
জয়দ্রথ প্রতি পার্থ গমিলেন ত্বরা।
যুধামন্যু, উত্তমৌজা রক্ষক তাহারা।।
কৃতবর্মা ও শ্রুতায়ু কম্বোজের বীর।
রোধিবারে পার্থে তারা করে মনস্থির।।
বরুণের পুত্র রাজা শ্রুতায়ু তখন,
বধিবারে কৃষ্ণে করে গদা নিক্ষেপন।।
সেই গদা সাথে সাথে আইল ফিরিয়া।
শ্রুতায়ুরে করে বধ আঘাত হানিয়া।।
সেনা কত হলো হত অর্জুনের বাণে।
আরো কত ভয়ে ভীত বাধ্য পলায়নে।।
হেরি তাহা দ্রোণে কন রাজা দুর্যোধন।
“মোর সেনা কত সব করে পলায়ন।।
যুদ্ধ রীতি হেরি মোর হইতেছে মনে,
আপনি করেন যুদ্ধ পাণ্ডব কল্যাণে।।
কৌরব আশ্রয়ে থেকে আপনি লালিত।
উত্তম বৃত্তি লভিয়া সকলে পালিত।।
হেন যুদ্ধ আপনার নহে সমীচীন।
না বুঝিনু আপনাকে আমি বুদ্ধিহীন।।
আপ্রাণ যুদ্ধ করুন রোধিতে অর্জুনে।
জয়দ্রথে ত্রাণ দিতে থাকে যেন মনে।।
কহিলেন দ্রোণ, “মোরে না বুঝিও ভুল।
মোর কাছে তুমি মম অশ্বত্থামা তুল।।
কভু আমি নাহি কহি অসত্য কথন।
এক্ষণে বাচিব যাহা করহ শ্রবণ।।
সারথি শ্রেষ্ঠ কেশব অশ্ব দ্রুত গামী।
রোধিবারে সাধ্য নাই ব্যর্থ হবো আমি।।
হয়েছে বয়স মোর গতি অতি শ্লথ।
নাহি সাধ্য রোধিবারে অর্জুনের রথ।।
তাই কহি আমি শোন রাজা দুর্যোধন।
মোর কাছে শিক্ষা তুমি করেছ গ্রহণ।।
কৃতী, বলশালী তুমি, তুমি মহাবীর।
পার্থ সনে যুদ্ধ লাগি কর মনস্থির”।।
কহিলেন দ্রোণ-কথা শুনি দুর্যোধন।
“একি কথা আজ আমি করিনু শ্রবণ।।
আপনারে যেইজন করে অতিক্রম।
রোধিতে তাহারে মোর নাই সে বিক্রম”।।
এতেক শুনি তাহারে কহিলেন দ্রোণ।
“এই কাঞ্চন কবচ করহ ধারণ।।
যত বড়ো যোদ্ধা হোক রেখ তুমি মনে।
সক্ষম নয়তো কেহ ইহারে ভেদনে।।
মহাদেব ইন্দ্র হ’তে এ কবচ পান।
বৃত্র বধ পূর্বে তাঁরে করিলেন দান।।
অতঃপর অঙ্গিরা, পরে বৃহস্পতি।
তারপর অগ্নিবেশ্য ঋষি মহামতি।।
পরিশেষে এ কবচ পাইলাম আমি।
এক্ষণে এই কবচ পেয়ে গেলে তুমি”।।
দুর্যোধন সে কবচ করিয়া ধারণ,
অর্জুনের সাথে যুদ্ধে করেন গমন।।
*
সূর্যদেব ক্রমে ক্রমে পশ্চিম গগনে।
দেখা তবু নাহি হয় জয়দ্রথ সনে।।
হেনকালে অবন্তীর ভ্রাতা দুই জনে,
উদ্যত হইল তারা অর্জুন হননে।।
হেরিয়া অর্জুন তাহা ত্যাজিলেন বাণ।
সেই বাণে দুই জন হলো নিষ্প্রাণ।।
অতঃপর কহিলেন অর্জুন কেশবে,
“রণক্লান্ত অশ্ব মোর তৃষ্ণাতুর সবে।।
জলাশয় আমি এক করিব নির্মাণ”।
হেন কহি পার্থ ভূমে ভেদিলেন বাণ।।
ভূমি ভেদি মিঠে বারি হইল নির্গত।
হেনরূপে জলাশয় হইল নির্মিত।।
পান করি ঠাণ্ডা বারি তৃপ্তি সবাকার।
অতঃপর বেগে রথ চলে পুনর্বার।।
কৃষ্ণার্জুন তীব্র গামী করি আলোড়ন।
অদূরে জয়দ্রথের পান দরশন।।
তাঁর দিকে দোঁহে তাঁরা করেন গমন।
রোধিবারে আইলেন রাজা দুর্যোধন।।
কহেন কৃষ্ণ, “সম্মুখে শত্রু দুর্যোধন।
নিমেষে পার্থ তাহারে করহ নিধন”।।
পার্থ করেন নিক্ষেপ বাণ অনর্গল।
কিন্তু কবচ কৃপায় সকলি বিফল।।
হেরিয়া কেশব তখন হেন অঘটন।
গাণ্ডীবধারী অর্জুনে কহেন তখন।।
“অদ্ভুত ঘটনা দেখি আজি ঘটমান।
মনে হয় জলে যেন ভাসিছে পাষাণ।।
তোমার বাণেতে দেখি কিছু নাহি হয়।
গাণ্ডীবের শক্তি নিয়ে জাগে সংশয়”।।
হেন বচন অর্জুন করিয়া শ্রবণ,
দ্বারকাপতি সারথি কেশবেরে কন।।
“হেন ঘটনা ঘটিছে নহে অকারণ।
অভেদ্য কবচ আজি করেছে ধারণ।।
সকলি বিফল তাই তাহার কারণে।
এ হেন ধারণা মোর হইয়াছে মনে।।
কিন্তু আজি বৃথা তার কবচ ধারণ।
রীতি নাহি জ্ঞাত তার করিতে বন্ধন।।
স্বর্ণ কবচ বন্ধনে আছে গূঢ় রীতি।
রীতিভ্রষ্ট দুর্যোধন অতি মূঢ় মতি।।
তাই শোন হে কেশব নাই কোন ভয়।
অতি সহজে করিব আমি তারে জয়”।।
ছিন্নধনু দুর্যোধন অর্জুনের বাণে।
অশ্ব সারথিরে তাঁর বধিলেন প্রাণে।।
মহাবিপদে বিপন্ন হন দুর্যোধন।
পলায়ন ভিন্ন তাঁর গতি কি এখন।।
হেরি কর্ণ কৃপ শল্য সকলে তখন,
সসৈন্যে অর্জুনে তাঁরা করেন বেষ্টন।।
গাণ্ডীবে অর্জুন তাই দেন টংকার।
ভ্রাতাগণে ডাক দেন তিনি বারবার।।
কেশবও করিলেন পাঞ্চজন্য নাদ।
শ্রবণে পাণ্ডবগণে গণেন প্রমাদ।।
সাত্যকিরে সেইক্ষণে কন যুধিষ্ঠির,
“অর্জুন বিপন্ন আজ নিশ্চয়ই স্থির।।
যাও সাত্যকি অর্জুনে দানিবারে ত্রাণ।
শত্রুসেনা মাঝে তার যায় বুঝি প্রাণ”।।
সাত্যকি কহেন তাঁরে, “সেকি মহারাজ।
আপনার রক্ষা লাগি রহিলাম আজ।।
লইনু শপথ আমি দায়িত্ব পালনে।
যেতে পারি আমি তাই ছাড়িয়া কেমনে।।
যদি যাই চলে আমি অর্জুনের পাশে।
করিবেন বন্দী তবে দ্রোণ অনায়াসে।।
রহিলে প্রদ্যুম্ন হেথা কেশব নন্দন।
ভার দিয়ে তারে আমি করিব গমন”।।
এতেক শুনিয়া তাঁরে কন যুধিষ্ঠির,
“গমনের তরে তুমি কর মনস্থির।।
নাহি রহিলে প্রদ্যুম্ন রবে ঘটোৎকচ।
তার পিতা ভীমসেন রক্ষার কবচ”।।
কহেন সাত্যকি ভীমে, “রক্ষিতে অর্জুনে
করিনু গমন আমি শোন এই ক্ষণে।।
মহারাজে করো রক্ষা কর্তব্য তোমার।
লভিয়া বিজয় মোরা ফিরিব আবার।।
পাপী জয়দ্রথে পার্থ করিলে হনন,
ফিরিয়া দায়িত্ব আমি করিব গ্রহণ”।।
কুরুসেনা সব তিনি করি বিদারণ,
সসৈন্যে সাত্যকি রণে করেন গমন।।
কহিলেন দ্রোণ তাঁরে, “শোন হে সাত্যকি,
না করিয়া জয় মোরে যাইবে সাধ্য কি”?
কহেন সাত্যকি দ্রোণে, প্রণমি চরণ,
“রক্ষিতে অর্জুনে আমি করিনু গমন।।
প্রার্থনা করি মঙ্গল হোক আপনার।
চলি আমি ত্বরা সেথা দেরী নয় আর”।।
এত কহি প্রদক্ষিণ করিলেন দ্রোণে।
অতঃপর উদ্যোগী হইলেন গমনে।।
দ্রোণ আর কুরুসেনা রোধিবারে গতি,
করিতে লাগিল যুদ্ধ ভয়ানক অতি।।
দ্রোণের সারথি শরে হইল নিষ্প্রাণ।
উদ্ভ্রান্ত রথাশ্ব সব শুধু ঘূর্ণমান।।
ত্যাজিলেন সাত্যকিরে কুরু বীরগণ।
রক্ষিবারে দ্রোণ পাশে সকলে তখন।।
বিধ্বস্ত হইয়া দ্রোণ আহত শরীরে,
ব্যূহদ্বারে তাড়াতাড়ি আইলেন ফিরে।।
সাত্যকির সাথে যুদ্ধে করিতে বিনাশ,
আইল যবনসেনা তাঁহার সকাশ।।
সাত্যকি করেন তীব্র শর বরষণ।
লৌহ কাংস্য বর্ম তায় হইল ছেদন।।
যবন কম্বোজসেনা সব রণ ভূমে,
হইয়া মৃত পতিত শোণিত কর্দমে।।
সাত্যকির পরাক্রমে ভীত দুঃশাসন।
দ্রোণ পাশে ত্বরা তিনি করেন গমন।।
কহিলেন দ্রোণ তাঁরে, ” কেন হও ভীত ?
জয়দ্রথ আছেন কি এখনো জীবিত ?
তুমি হও মহাবীর তুমি মহাবল।
ত্যাজিলেন কেন তবে আজি রণস্থল ?
দ্যূতসভায় করিলে কত আস্ফালন।
কোথা গেল আজ তব বীরের গর্জন”?
দ্রোণের ভর্ৎসনা হেন করিয়া শ্রবণ,
রণিতে সাত্যকি সনে করেন গমন।।
কিন্তু তিনি পরাজয় করিয়া বরণ,
করিলেন পলায়ন ছাড়ি রণাঙ্গন।।
অপরাহ্ণে দ্রোণ রণে করেন গমন।
রণস্থলে দুই দল যুঝিল ভীষণ।।
করিলেন দ্রোণ তীব্র শর বরষণ।
কেকয়রাজের তাহে হইল পতন।।
আর হত ধৃষ্টকেতু শিশুপাল সুত।
তারি সাথে ক্ষত্রধর্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন পুত।।
★★★★
(চলবে)
Show quoted text