★ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য★
* কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *
—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৮
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
৯। জয়দ্রথের ভয়
সুভদ্রা বিলাপ।।
চরমুখে সেই পণ করিয়া শ্রবণ।
আতঙ্কিত জয়দ্রথ দুর্যোধনে কন।।
“অর্জুন করিল পণ অতীব ভীষণ
আগামীকাল সে মোরে করিবে হনন।।
মঙ্গল হোউক তব করিনু কামনা।
আমি ভাই দিব তাই বাড়িতে রওনা।।
অথবা অভয় দেহ তোমরা আমারে।
অর্জুন হস্ত হইতে রক্ষিবে আমারে।।
সিংহনাদ শ্রবণে হইয়াছে ভয়।
ভীত আমি অর্ধমৃত বোধ মনে হয়।।
অনুমতি দাও তুমি গোপনে থাকিতে।
কেহ যেন নাহি পায় আমারে দেখিতে”।।
“ভয় নাই শোন তুমি,” কহে দুর্যোধন।
“ক্ষত্রিয় বীর মাঝে কে করিবে হনন?
নরব্যাঘ্র তুমি তবে কেন পাও ভয় ।
রক্ষিব তোমারে মোরা দিলাম অভয়।।
রথীশ্রেষ্ঠ তুমি নিজে অতি মহাবীর।
তবে কেন আজ তুমি হয়েছ অধীর” ?
*
নিশাকালে জয়দ্রথ আর দুর্যোধন।
দ্রোণ সকাশে তাঁহারা করেন গমন।।
কহিলেন জয়দ্রথ প্রণমি তাঁহারে।
আচার্য একটি কথা কহি আপনারে।।
“অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত আপনার কাছে।
অর্জুনে আর আমাতে ভেদ কিবা আছে”?
কহেন দ্রোণ,”বৎস কহি আমি শোন।
সমভাবে শেখালাম নাই ত্রুটি কোন।।
কিন্তু অভ্যাস কত যে করিল অর্জুন।
তার ফলে শক্তিমান হলো বহু গুণ।।
তথাপি তুমি আজিকে না করিও ভয়।
সর্বশক্তি দিয়ে মোরা রক্ষিব নিশ্চয়।।
এমন একটি ব্যূহ করিব রচন।
অর্জুন নারিবে কভু করিতে ভেদন।।
রণে রত রবে তুমি স্বধর্মানুসারে।
আমরা সবে নিশ্চয় রক্ষিব তোমারে।।
চিরকাল রহিবে না মোদের জীবন।
কালবশে পরলোকে করিব গমন”।।
হেন বচন দ্রোণের করিয়া শ্রবণ।
জয়দ্রথ স্বস্তি পান আনন্দিত মন।।
চলেন শিবিরে তিনি ত্যাজি যত ভয়।
প্রস্তুতি নিলেন যুদ্ধ করিবারে জয়।।
★
পাণ্ডবশিবিরে কৃষ্ণ কহেন অর্জুনে।
করিলে ভীষণ পণ তাহারে নিধনে।।
করিলেনা মোর সাথে কোন আলোচনা।
ক্রোধবশে কর পণ ত্যাজি বিবেচনা।।
পাঠালাম চর আমি কৌরব শিবিরে।
আসি ফিরে গুপ্ত কথা কহিল আমারে।।
মহারথ ভুরিশ্রবা আর অশ্বত্থামা।
বৃষসেন কৃপাচার্য আর শল্য মামা।।
এই সব মহারথ তাঁরা ছয় জন।
রক্ষিবেন জয়দ্রথে করিয়াছে পণ।।
না জিনিয়া এই সব ছয় মহারথে।
কেমনে বধিবে কাল তুমি জয়দ্রথে।।
এতেক শুনিয়া কৃষ্ণে কহেন অর্জুন।
মিলিত শক্তি এঁদের মম অর্ধগুণ।।
চিন্তা নাই তুমি শোন হে মধুসূদন।
জয়দ্রথ-মুণ্ড কাল করিব ছেদন।।
ক্ষীর ভোজী পাপাচারী ওই জয়দ্রথ।
তার সনে থাক যত রথী মহারথ।।
দেখিবে সকলে কাল এ আমি নিশ্চিত।
ছিন্নমুণ্ড জয়দ্রথ ভূতলে পতিত।।
থাকিলে গাণ্ডীব ধনু কেশব সারথি।
সবকিছু জিনি আমি সহজেই অতি।।
কাল প্রাতে রথ মোর রাখিবে সজ্জিত।
তার লাগি সদা তুমি রহিবে চেষ্টিত।।
ভগিনী সুভদ্রা পাশে গমিও এক্ষণে।
অভাগিনী কেঁদে মরে পুত্রের বিহনে।।
পুত্রবধু উত্তরায় বাচিও সান্ত্বনা।
অকালে খোয়ালে ধব মনেতে যাতনা।।
★
কৃষ্ণ গমিলেন তথা অর্জুন সদনে।
সুভদ্রায় দেন শান্তি সান্ত্বনা বচনে।
“অভিমন্যু লাগি তুমি করিও না শোক।
কালবশে সকলেই যাবে পরলোক।।
মহৎ ক্ষত্রিয় কুলে জনম যাহার।
এ মৃত্যুই উপযুক্ত কামনা তাহার।।
পিতৃ সন্নিভ করিল যুদ্ধ বীরোচিত।
তারপর গতি তার ক্ষত্রসমুচিত।।
মহাজ্ঞানী সাধুজন যেথা যায় সবে।
পুত্র তব সেথা আজ বিরাজে বৈভবে।।
মহাবীরপত্নী তুমি কেশব ভগিনী।
না করিও শোক তুমি বীর প্রসবিনী।।
জয়দ্রথ কর্মফল পাইবে নিশ্চয়।
দেবপুরে হইলেও তাহার আশ্রয়।।
করিবে শ্রবণ কাল জয়দ্রথ মৃত।
ছিন্ন মুণ্ড শরাঘাতে ভূমিতে পতিত।।
দেহবিচ্যুত নিশ্চিত তাহার মস্তক।
যাবে উড়ে বহু দূরে সমন্ত পঞ্চক।।
পুত্রবধুরে আশ্বস্ত করহ এখন।
কাল প্রিয় সংবাদ করিবে শ্রবণ।।
যে অঙ্গীকার করিল তব পতিপ্রভু।
অন্যথা তার জানিও হইবে না কভু”।।
★
০ সুভদ্রা বিলাপ ০
অভাগিনী ক্রন্দিনী পুত্র বিরহিণী,
অভিমন্যু মাতা।
কেশব ভগিনী বাসুদেব নন্দিনী,
পুত্রশোকাপ্লুতা।।
হা পুত্র, তব বিহনে বাঁচিব কেমনে,
দগ্ধ এ জীবন।
বাঁচিবারে তাই আমি নাহি চাই,
এসো হে মরণ।।
পিতৃতুল্য পরাক্রান্ত যুঝিলে অবিশ্রান্ত,
তথাপি হইলে হত।
নরপশু কুরুপতি ভাঙিল যুদ্ধরীতি,
নরকে হইবে পতিত।।
বিদীর্ণ হৃদয় মম শুষ্ক মেদিনী সম,
অশ্রুসিক্ত তবু এ নয়ন।
দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় শয়ন করিতে হায়,
আজি কেন ভূতলে শয়ন।।
বরনারীগণ সেবিত সর্বক্ষণ,
উত্তরা সঙ্গিনী।
আজ আর কেহ নাই ভূতলে শায়িত তাই,
চারিদিকে গৃধিনী।।
জঙ্গলী শিবা দলে মিলিয়া সকলে,
বধিল সিংহশাবকে।
কি কহিব অধিক ভীমার্জুন সবে ধিক,
রক্ষিতে নারিল বালকে।।
ক্ষণিকের তরে পাইলাম তারে,
হারালাম চিরতরে।
উত্তরা দুখিনী দিবস যামিনী,
অভাগিনী কাঁদিয়া মরে।।
শূন্য হৃদয় তার করে হাহাকার,
নাহি পায় দিশা।
দুখিনী অকালে পতিরে খোয়ালে,
এ কী অমানিশা।।
যজ্ঞকারী সাধুজন ব্রহ্মচর্য পরায়ণ,
করেন গমন যেথা,
সেই দেবলোকে তুমি স্বর্গসুখে,
কর বাস সেথা।।
★
এইরূপে বিলাপেন সুভদ্রা উত্তরা।
হেন সময় দ্রৌপদী আইলেন ত্বরা।।
ব্যাকুল শোকার্ত তাঁরা সকল ক্রন্দিত।
তিনজন অচেতন ভূতলে পতিত।।
ত্বরা করি কৃষ্ণ বারি করেন সিঞ্চন।
ক্ষণিক পরেতে তাঁরা লভিল চেতন।।
কৃষ্ণ কন সুভদ্রায়, “ত্যাজ শোক ত্বরা।
তব শোকে সদা কাঁদে পাঞ্চালি উত্তরা।।
অভিমন্যু লভিয়াছে ক্ষত্রোচিত গতি।
ক্ষত্রকুল আকাঙ্খিত অতি প্রিয় গতি।।
মহৎ কর্ম করি সে লভিল মরণ।
সবে মোরা করি যেন সে মৃত্যু বরণ”।।
★★★★
(চলবে)