[ ১৩৪ লাইন, A Bengali Poem :- Bingsho Shotoker Durga Puja i.e. The Twentieth Century Durga Puja Festival, by Ridendick Mitro ]
————————————
ঋদেনদিক মিত্রো
বিংশ শতকের দুর্গাপূজা সেই,
পাচ্ছি না সেই রস এই শতকেই।
তোমরা যারা সেই দুর্গা পূজা দেখোনি,
তারা পড়ো সেই নিয়ে এই লেখনি।
অনুভুতি যদি থাকে করো অনুভব,
কিরকম ছিল সে-শারদীয়া উৎসব।
পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা বেরোলে —
তা কিনতে ভিড় হোতো বাজারে বা স্টলে।
দেড়-দু মাস আগে থেকে সেইগুলি পড়ে —
পূজার আবেশ হোতো শিক্ষিত-ঘরে।
কোনো বড় শিক্ষিতদের বাড়ি তখন —
পূজো সংখ্যা দিয়ে যেত ডাকের পিয়ন।
পূজা সংখ্যা হাতে পেয়ে হোতো যে অনুভব —
আজকে সেই অনুভুতি একদম নীরব।
মহালয়ার আগে থেকে হোতো আলোচনা —
কবে হবে রেডিওতে সেই উপস্থাপনা,
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই মন্ত্র পাঠ,
মহালয়ার ভোররাতে ঘুমিয়ে সজাগ —
সকলের অনুভুতি গভীর রকম,
রেডিওতে মহালয়া কী সুখ ভীষন।
এল যত টিভি, মোবাইল, কম্পুটার,
সেইসব সুখগুলো আজ ছারখার,
সে-শতক আলাদা তো, এল স্বাধীনতা,
মহান দিগের নিয়ে হোতো কত কথা,
সে-সব কিছুই নেই একবিংশতে,
অনেক টাকা থেকেও হাসি নেই মুখে।
গরিবের ছিল দুঃখ চিরকাল ঠিক,
তবুও তাদের মনে সুখ ছিল কিঞ্চিৎ।
এ শতকে সেই সব একেবারে শেষ,
কোথায় যে চলে গেছে আমাদের দেশ।
এ শতকেও মহালয়া রেডিওতে হয়,
বীরেব্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে দিগবিজয়।
কিন্তু সেই সময়ের মহালয়া-হাওয়া,
সেই অনুভুতি আজ যায় না পাওয়া।
সেই দুর্গাপূজা, আর সেই ছোটবেলা,
একখানি ছোট বল কিনে নিয়ে খেলা।
কখনো পুতুল কিনে কথা তার সাথে,
সেএক অন্য সুখ পুতুলটা হাতে।
ছোট-ছোট মেয়ে কিনতো ফিতে ও চুড়ি,
তাই নিয়ে আনন্দে কত ঘোরাঘুরি,
বড়রা তো সংসারি জিনিস খুঁজে —
কত কী যে কিনতো দর দাম বুঝে।
কত কী কেনার পর আরো কী কী সব —
না কিনতে পেরে দুঃখ সইতো নীরব।
ছোটরাও কিছু কিনে মিটতো না আশা,
তবু সে-সামান্য পাওয়ায় ছিল ভালবাসা।
বড়দের হাত ধরে মেলাতে যাওয়া,
ঘুগনি, চপ, বড়া, এটা সেটা খাওয়া।
সব কিছু ছিল অতি সাধারন চাওয়া,
তাতেই তো মনে হোতো বিরাট পাওয়া,
সেই সাথে রাত্রে পাড়ার যাত্রা,
মেলাতে সে-রাত পেতো ভিন মাত্রা।
যাত্রার পরে খাবে রান্না হোতো,
তাই নিয়ে ব্যাস্ততা, ছোটাছুটি কত।
ইস্কুলের ভাংগাচোরা বোড়িং ঘরে —
সেখানে মাটির বড় উনুন করে —
বিরাট কড়ায় মুসুরি ডাল ফুটছে,
পাঁচ ফোড়নের ঘ্রানে হাওয়া ছুটছে।
ভিড়ের মাঝ থেকেও সে-ডাল কড়ায় –
দূর থেকে দেখে মন আশায় গড়ায় —
মনে হোতো আহা যদি খেতে ডাকতো,
ডাল, ভাত, ঘন্টে খেতাম কতো,
সেই লোভ অনুভুতি আজো যাই ভেবে,
সে-ডাল কড়ার সুখ কে আমায় দেবে!
মেলায় বসতো কম টিকিটের সার্কাস,
তাই দেখতে কত ভিড়, শ্বাস হাসপাস।
কম টিকিটের সার্কাস, তবু করতো মুগ্ধ–
সকল দুঃসাহসিক কীর্তি সম মান যুদ্ধ।
ছোট সার্কাস, বড় সার্কাস, নেই পার্থক্য,
আজ বুঝি এই কথার গভীরতর সত্য।
পূজা প্যান্ডেল ছিল সাধারন তাঁবু,
দেখভালো করতেন কিছু-কিছু বাবু,
ছোটরাও কেঁদে-কেঁদে করতাম দাবী,
কত কী কেনার ইচ্ছে হোতো, আজ ভাবি।
সে-সব জিনিস আর সে-সব খাবার,
আজো ইছে করে জানো, সে-সব পাবার।
এই আজ এত কিছু, আধুনিক দামি,
চাইনা এসব কিছু আজকের আমি।
আমি চাই সেই ছোটবেলার পূজা,
সাধারন ভাবে গড়া মা দশভুজা।
সব কিছু সাধারন সহজ সরল,
সেই দিনগুলা চেয়ে চোখে আসে জল,
সেই সব পথঘাট মাটি, ধুলা, যা তা,
কোথাও-কোথাও বা ছিল ইটপাতা,৷
শহরতলি ও গ্রাম ছিলনা ফারাক,
দুর্গা পুজার ক্ষেত্রে ছিলনা তফাৎ।
বড় শহরের সব দুর্গা পূজায়,
যতই বিরাট হোক ব্যাবস্থাপনায়,
আড়ম্বরের মাঝে ছিল গ্রাম-ভাব,
দেওয়া হোত লাইন করে মায়ের প্রসাদ।
এখোনো তা দেওয়া হয়, কিন্তু সেই ছবি —
অনেকটা আলাদা, আজ এই ছবি।
বিংশ শতকের সব মানুষেরা দেবতা,
কখোনো বলিনা আমি এই ভুল কথা।
ঘর, বাহির সব খানে কূটীলের চক্র,
সম্পর্কে যেই হোক, থাকিবে সতর্ক,
কূটীলের নানা রূপ অভিনয় ভংগী,
না বুঝিলে সেই জন্মে দুঃখ চিরসংগী।
আবেগ ও সংস্কারের নানান জড়টা,
থাকিলেই বিপন্নতা, এটা শেষ কথা।
শিক্ষা মানে ইস্কুল কলেজের ডিগ্রি নয়,
শিক্ষা মানে নয় কখোনো ভীরুর বিনয়,
শিক্ষা মানে সুক্ষ্ম বুদ্ধি ও কূটীলকে চেনা,
কোনো সম্পর্কের আবেগে হবেনা তো কেনা।
যত থাক ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও স্নেহ,
নিজেকে জাগিয়ে রাখো ঘুমের মাঝেও।
সে-যুগ, এ-যুগ বলে নেই তো ফারাক,
এবার তোমার বুদ্ধি বোকামি ছাড়াক।
কে কাকে কী খেলায়, কে কাকে কী বলায়,
মূহুর্তে না বুঝলে তুমি সব জ্বলে যায়।
দুর্জনের যোগে থেকে চাহো শান্তি, সুখ,
এর চেয়ে আছে নাকি আর কে উজবুক!
যাই হোক, বিংশ শতের দুর্গা পূজা নিয়ে –
বলতে গিয়ে গিয়েছি কত গভীরে তলিয়ে।
ছিল নানা বাজে লোক, পুরুষ ও নারী,
নানা দিকে তারা ধূর্ত, এড়াতে কি পারি!
কিন্তু আমি বলছি যেটা উৎসবের কথা —
ছিল সরল অনুভুতিময় অকৃত্তিমতা।
একবিংশ শতকে কিছু নেই আর,
আছে শুধু ভুল কথা আর অহংকার।
অতি আধুনিক হতে সব দিশাহারা,
উৎসবগুলি গেছে আজ প্রানে মারা।
নেই আর ছোটদের কান্না, আবদার,
ছোটরা বড়র মত মালিক টাকার,
সরকার থেকে করে দেয় পাস বই,
সেই শৈশব আজ হায় খুঁজে পাবো কই!
গ্রামে ছিলো না বিদ্যুৎ, ও শহরতলিতে –
বিদ্যুৎ ছিলনা কত বাড়ি,পথ ও গলিতে।
ছিল চাঁদ ও জ্যোৎস্না — অপরূপা রাত,
সেই জ্যোৎস্না নিরাশ, এত বিদ্যুতের উৎপাত।
মাঠ ঘাট, দিগন্ত, সব হোলো শেষ,
শহরায়ন হয়ে যায় গ্রাম ভরা দেশ।
জীবনের সেরা উৎসব — দুর্জনকে ছাড়ো,
এই বুদ্ধি, সাহস নেই, — কিছু নাহি পারো।
————————————————-
[ ৩-৪ অক্টোবর ২০২২ ]
————————————————-
ঋদেনদিক মিত্রো (Ridendick Mitro) পেশায় ইংরেজী ও বাংলাভাষায় কবি-উপন্যাসিক-গীতিকার- কলামনিষ্ট। কলকাতা, ভারত।