'কনে দেখা'
রম্যরচনা
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
মোটামুটি উনিশশো সত্তর সালের কথা।বাতাসপুরের অমিয় পাল গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর নিয়ে একমাত্র ছেলে ভজহরির বিয়ের উদ্দেশ্যে গোরুর গাড়ীতে চেপে তিনক্রোশ দুরে সাজুইমাটি গ্রামের তিনকড়ি দে মহাশয়ের বাড়ি পৌঁছালেন। তিনকড়ির তিনটি মেয়ে। বড় মেয়ে বৈশাখী, দ্বিতীয় শ্রাবণী ও ছোট ফাল্গুনী। তিনকড়ি বাবু হাত পা ধোওয়ার জন্য জলভর্তি জগ্ দিলেন। ছেলে পক্ষ বললেন আমরা ধূলি পায়ে কনে দেখবো! তারপর হাত পা ধোয়া,ও জলখাবার খাবো।তিনকড়িবাবু ও বাড়ীর সবাই অপ্রস্তুত। মেয়ে সাজানো হয়নি।না দেখে চা জলখাবার উনারা খাবেন না।ভারী মুস্কিলে পড়লেন। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরিয়ে নিয়ে এলেন।
মাদুর পেতে রাখা আছে ওখানে পাত্রপক্ষ বসলেন। সামনে একটি কম্বলের আসন পাতা হলো।
সাতকড়ি মেয়েকে ডাকলেন মা বৈশাখী এসো মা! বৈশাখী খুব মোটাসোটা ,এসেই সকলকে প্রণাম ক’রে বসতে যাবে এমন সময় পাত্রপক্ষ থেকে বলা হলো এখন বসবে না!
বৈশাখী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অমিয় বাবু বললেন একটি জলভর্তি থালা আনুন।সাতকড়ি বাবুর স্ত্রী নন্দরানী থালা আনলেন ও থালায় জল ঢাললেন।অমিয় বাবু বললেন মা বৈশাখী পা জলে চুবিয়ে একটু হাঁটো যেন পায়ের ছাপ পরে। বৈশাখী আলতা পরা পায়ে দুই পা বেলীথালায় চুবিয়ে পায়ের ছাপ দিল। মাটির বারান্দায় পায়ের লাল ছোপ দেখা গেলো। বৈশাখীর মা তাড়াতাড়ি পা মুছিয়ে দেওয়ার পর আসনে বসলো।
অমিয় বাবু বললেন – পড়াশোনা কতদূর আর কি কি জানো। কথার উত্তরে মেয়ের মা বললেন যে মেয়ে আমার পড়াশোনায় দশের মধ্যে একজন।
অমিয় বাবু বললেন – মা বৈশাখী তোমাদের ক্লাসে কতজন ছেলে মেয়ে পড়ে।
বৈশাখী উত্তরে বললো দশজন। সাতকড়ি বাবু বললেন দেখলেন তো দশের মধ্যে আমার মেয়ে। মিথ্যা কথা ব’লে বিয়ে দেবো না।
সাতকড়িবাবু বললেন মেয়ে আমার মোটা ব’লে শ্বাস-প্রশ্বাসে কথা বলতে একটু কষ্ট হয়। তবুও গানবাজনা, হাতের কাজ, রান্না বান্না সব জানে।
ঠিক আছে বললেন অমিয় বাবু! তাহলে একখানি গান হোক। তাড়াতাড়ি তক্তার উপর রাখা হারমোনিয়াম নিয়ে সাতকড়ি বাবু মেয়ের সামনে রাখলেন। মেয়ে একটিই গান শিখেছে। গানটা রিহার্সাল করতে প্যা পু শব্দে হারমোনিয়াম বাজিয়ে চলেছে।
অমিয় বাবু বললেন মা বৈশাখী গান গাও। বৈশাখী নমস্কার করে গান ধরলো ” কি গাব আমি কি শোনাবো আজি আনন্দ ধামে” ! হারমোনিয়ামের বেলোর বাতাসের ও বৈশাখীর নাক মুখের হাসফাঁসের শব্দ একাকার।
অমিয় বাবু বললেন রাগ জানো? সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের মা বললেন – আমার মেয়ের রাগ নেই, খুব ভালো মেয়ে। ঝগড়া ঝাটি কারো সঙ্গে করেনা!
কমল বাবু বললেন- খেয়াল জানো না?
আবার মেয়ের মা – বৈশাখী একটু খামখেয়ালী বুঝলেন।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না। তাছাড়া সঙ্গীতের উদ্বোধনী সঙ্গীত থেকে সমাপ্তি সঙ্গীত জনগনমন অধিনায়ক সব জানে।
অমিয় বাবু – আর বেশি খাওয়াবেন না! দম আটকে যাবে আপনার মেয়ের। এই শরীর নিয়ে চলাফেরা করাই তো কঠিন! আর দুটো মেয়ে নিশ্চয়ই তারা মোটা!
মেয়ের মা- যাকে দেখতে এসেছেন তাকে দেখুন, আর দুটো ডেকে কি লাভ? আমি তো ওদের বিয়ে দিচ্ছি না!
অমিয় বাবু – তা বলছি না।বলছি আপনাদের সবাই মোটাসোটা!
এবার সাতকড়ি বাবু বললেন – স্বাস্থ্যই সম্পদ ! সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ক’জন হ’তে পারে?
অমিয় বাবু- সুস্বাস্থ্য ভালো কিন্তু নীরোগ হতে হবে !
মেয়ের মা – আ মরণ! শরীরের উপর নজর কেন আপনাদের? কারো বাপের খেয়ে মোটা হয়নি — নিজের বাপের খেয়ে মোটা হয়েছে। তা বুঝি আপনার ছেলে কি ফড়িং? উড়ে উড়ে বেড়ায়? ঝড়ে উড়ে যাবে আপনার ছেলে কিন্তু আমার মেয়েকে নড়াতে পারবে না বুঝলেন।এ শক্ত খুঁটি। আপনার বাড়ীতে ঢুকবে আর শিবের মতো মাটি গেড়ে বসে পড়বে।
অমিয় বাবু বললেন – চলো গো সবাই! ওঠা যাক্ এবার।
সাতকড়িবাবু বললেন – সেকি? এতো আয়োজন করলাম নষ্ট হবে যে? সম্পর্ক হোক না হোক – না খেয়ে গেলে বাড়ীর অমঙ্গল হয়! অমিয় বাবু গোরুর গাড়ীতে উঠে বসলেন! সাগরেদ মাতব্বরেরা লুচি মিষ্টির গন্ধে লুকোচুরি শুরু করলেন। অমিয় বাবু রাখাল দিয়ে গোরু তাড়া করতে লাগলেন।শাগরেদরা কাপড় কোঁচা মেরে পরে লুচি মিষ্টি থালা থেকে তুলে নিয়ে পিছন পিছন ছুটতে লাগলেন। গোরুর গাড়ি বাড়ীর টানে ছোটে আর মাতব্বর সাগরেদরা ছুটেও নাগাল পেলেন না। খেতে খেতে আর কতো দৌড়াবে ওঁরা।
—————————————————
কলমে : অরবিন্দ সরকার