একদিনের ঝটিকা সফরে
সুন্দরী ‘বড়ন্তি’
***********
রাজকুমার সরকার
১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ শনিবার ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ন’টা বেজে দশ। ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার বেলিয়াপুর থানান্তর্গত ‘মোকো’ গ্রামের ‘পুষ্পভিলা’ থেকে বের হলাম মোটরসাইকেল নিয়ে। হ্যাঁ, ‘পুষ্পভিলা’ ‘সুতপা’র সদর দপ্তর।
গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার পথ দুধিয়া মোড়।সেখান থেকে শালুকচাপড়া, পিন্ড্রাহাট, কেলিয়াশোল, বেনাগড়িয়া পার হয়ে পাতলাবাড়ি মোড়। সেখান থেকে টার্ন নিলাম পাঞ্চেত ড্যামের দিকে। পাঞ্চেত ড্যাম পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রবেশ। খানিকটা গিয়েই পুয়াপুর মোড়।
ঝাড়খণ্ডের মানুষরা পুয়াপুরকে বলে পঞ্চকোটের প্রবেশদ্বার। ডানদিকে পুয়াপুর গ্রাম পার হলেই দুইধারে হোটেল, লজ, রিসর্ট দেখতে পাবেন। যাঁরা পঞ্চকোট ঘুরতে আসেন তাঁরা এখানে থাকতে পারেন। এখন আমার গন্তব্য ‘বড়ন্তি’ তাই এপ্রসঙ্গ বন্ধ রাখছি।
পুয়াপুর, রানীপুর পার করে পৌঁছলাম সরবড়ি মোড়। সরবড়ি মোড় থেকে ডানদিকে গাড়ি চলতে লাগলো। গাড়ি
থামালাম সুভাষ মোড়ে। এখানে আমার চা ব্রেক। সুভাষ
মোড় থেকে বাঁহাতি তিন কিলোমিটার গিয়ে রামচন্দ্রপুর গ্রাম।রামচন্দ্রপুর পার করে সোজা মুরাড্ডি গ্রাম।
হ্যাঁ, মুরাড্ডি গ্রাম পেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে দেখি সবুজের হাতছানি। মুরাড্ডি সরকারী হাসপাতালকে পেছনে রেখে এগোতে থাকলাম। ডানদিকে সাঁতুড়ি বাজার সমিতি। তারপরই শুরু আমার সফরের মূল কেন্দ্র ‘বড়ন্তি’ ।
মুরাড্ডি আমার মাতুলালয়। আমার ছেলে বিতান যখন তিন চার বছরের তখন আমরা মুরাড্ডি ড্যাম ঘুরতে গেছিলাম। তখন পাহাড় এবং ড্যামটিই শুধু ছিল আর কিছুই ছিল না। ড্যাম পেরিয়ে ছোট গ্রাম বড়ন্তি। এই বড়ন্তি আদিবাসীদের গ্রাম। গয়লা, বাউরী সম্প্রদায়ও আছে। আমরা মুরাড্ডি ড্যাম বলেই ছোট থেকে জেনে আসছি;শুনে আসছি।
রামচন্দ্রপুর সেচ প্রকল্প, বড়ন্তি ড্যাম আবার মুরাড্ডি ড্যাম। কোন নামে ডাকবেন?
এবার বুঝুন ঠ্যালা …….
কোন নামটি সঠিক?
জানতে পারলাম সরকারিভাবে এটির নাম রামচন্দ্রপুর সেচ প্রকল্প। এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রয়েছে রামচন্দ্রপুর পাহাড়। ওখানেই ড্যামটি হওয়ার কথা ছিল, কোনো কারণে হয়নি কিন্তু পুরোনো নামটিই সরকারিভাবে আজও থেকে গেছে। মুরাড্ডি এলাকার বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে তাই মুরাড্ডি ড্যাম বলেই সবাই জানে; আমরাও জেনে আসছি ছোট থেকেই।
কিন্তু ‘বড়ন্তি’ নাম কিভাবে এলো?
প্রশ্ন আসতেই পারে।
কিছু কিছু নাম মানুষকে হঠাৎই খুব আকর্ষন করে ফেলে।বড়ন্তি’র ক্ষেত্রেও তাই।
হ্যাঁ, ‘বড়ন্তি’ গ্রামের জায়গাও গেছে ড্যামে। ‘বড়ন্তি’ নামটিতে একটু নতুনত্ব আছে তাই বহুল প্রচার হয়েছে এই ‘বড়ন্তি’ নামটিই। পাহাড়, ড্যাম ও চারদিকে সবুজের হাতছানি যে কোনও মানুষের মন টানে। সরল সিধা আদিবাসীদের রাস্তা দিয়ে আনাগোনা চোখে পড়ে। ড্যাম এর ঘাটে ঘাটে ছোট ছেলেমেয়েদের লাফালাফি নজরে পড়ে।তারা স্নান করে।পাথরে কাপড় কাচে।মাছ ধরে।
এখন গজিয়ে উঠেছে অনেক হোটেল,লজ, রিসর্ট।কিসের আকর্ষনে এত হোটেল, লজ, রিসর্ট?
একটু খোলসা করে বলা যাক্।মুকুন্দ জোড়, তালবেড়িয়া জোড়,মুরাড্ডির জোড়,আমহিঁড়ের জোড় এই চারটি জোড় নিয়ে বড়ন্তি ড্যাম (জলাধার) নির্মাণ হয়।এর ফলে প্রায় কুড়ি- পঁচিশটি গ্রাম উপকৃত হয়।পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি হোলো ভেটি,মুরাড্ডি,
তালবেড়িয়া,বড়ন্তি,
রায়জীবনপুর, শিয়ালডাঙ্গা,মানপুর, দুলুরডি।
মুরাড্ডি গ্রামের চন্দন রায়ের মাথায় আসে এই বড়ন্তি একদিন পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে।তিনি একটি রিসর্ট গড়ে তোলেন এই সবুজের বুকে।তখন তাঁকে অনেকেই বিদ্রুপ করেছিলেন । কিন্তু তিনি কারও কথায় কান না দিয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকেই চলতে থাকেন।গড়ে তুলেন Baranti Wildlife & Nature Study Hut.
তাঁর দেখাদেখি আরও অনেকেই একের পর এক লজ, হোটেল,রিসর্ট নির্মাণ করেন। কোলকাতার অনেক ব্যবসায়ীদের নজরে আসে বড়ন্তি এলাকা।
এখন বড়ন্তি’তে হয়েছে প্রচুর হোটেল, লজ, রিসর্ট। বিলাসবহুল রিসর্টগুলিতে আপনি কয়েকদিন থেকে যেতে পারেন এই সবুজের দেশে। পর্যটকরা এই বড়ন্তি’কে কেন্দ্র করে ঘুরে নেন আরও সামনাসামনি পর্যটন স্থলগুলি।
গড়পঞ্চকোট, জয়চণ্ডীপাহাড়, মাইথন, পাঞ্চেত, বিহারীনাথ, অযোধ্যা ইত্যাদি। আসলে এই জায়গাটি শান্তিতে থাকার উপযুক্ত জায়গা এবং অনেকটাই নিরিবিলি। আপনি হঠাৎ করে এলে ভাববেন এখানে এত রিসর্ট, হোটেল, লজ কিভাবে চলে?
না না বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই পরিযায়ী পাখিদের মত মানুষেরা আসতে থাকেন এই সবুজের দেশে। একদম পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত ভীড় থাকে। হোটেল রিসর্টগুলি পর্যটকদের ভিড়ে ঠাঁসা।সুন্দর সুন্দর মনকাড়া নাম রিসর্ট, লজ ও হোটেলগুলির।
পলাশ কুঞ্জ,পলাশ বাড়ি, পলাশ কুইন,পলাশ কুঠি,মনপলাশ,কিংশুক,কুহু, বড়ন্তি ভিলেজ রিসর্ট, অ্যালবাম, মানভূম হলিডে হোম, বনবীথি,আকাশমণি, আরণ্যক, পাহাড়তলি, মেঘরোদ্দুর,রাধারানী ইত্যাদি।
বড়ন্তি মূলত আদিবাসী অঞ্চল। গয়লা, বাউরী সম্প্রদায়ের বাসও এখানে।বড়ন্তি নামটিই জনপ্রিয়তা হাসিল করতে পেরেছে রামচন্দ্রপুর ও মুরাড্ডিকে পেছনে ফেলে।
আসানসোল থেকে আদ্রা পুরুলিয়াগামী
(দক্ষিন পূর্ব রেল)
৩৭ কিলোমিটার দূরে মুরাড্ডি স্টেশন।মুরাড্ডি স্টেশন- এ নেমে যাওয়া যায় বড়ন্তি।মুরাড্ডি স্টেশন এখন
অনেক উন্নত হয়েছে। সবই পাওয়া যায় স্টেশন বাজারে। মাছ, মাংস, তরিতরকারি সব পাবেন। সেখান থেকে অটো,
টোটো, রিক্সা করে যাওয়া যায় বড়ন্তি। আসানসোল স্টেশন থেকে মাত্র তিনটি স্টেশন পেরিয়ে মুরাড্ডি স্টেশন।আসানসোল থেকে বার্নপুর,দামোদর ও মধুকুণ্ডা পেরিয়ে মুরাড্ডি স্টেশনে নামতে হয়। আদ্রা হয়ে আসার সময় জয়চণ্ডীপাহাড় বেড়ো ও রামকানালী’র পর মুরাড্ডি রেলস্টেশন। মুরাড্ডি স্টেশন থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার পথ বড়ন্তি। আসানসোল থেকে বাসরুটে আসা যায়। আসানসোল বরাকর ডিসেরগড় হয়ে সরবড়ি মোড় হয়ে সুভাষ রোডে নামতে পারেন। সেখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে বড়ন্তি। সেক্ষেত্রে সুভাষ মোড় থেকে টোটো রিজার্ভ করে নেওয়াটাই ভালো হবে।
পুরুলিয়া থেকে বরাকর আসানসোলগামী বাসে এলেও রঘুনাথপুর হয়ে সেই সুভাষ মোড়ে নামতে হবে।
বড়ন্তি’র জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অসংখ্য ছোট বড় মাঝারিমানের হোটেল, লজ, রিসর্ট গজিয়ে উঠেছে।
গীতাঞ্জলি, সাই ইকোলোজিক্যাল রিসর্ট, সলিটারি ভেল,মহুলবন লেক রিসর্ট, গ্রীনপার্ক, লেক হিল রিসর্ট,আনখাইবাড়ি, মানভূম রিসর্ট, রিট্রিট সহ অনেক রিসর্ট,লজ,হোটেল রয়েছে বড়ন্তি’তে।
মুরাড্ডি গ্রাম শেষ করেই যখন ড্যামের দিকে যাবেন তখন প্রথমেই চোখে পড়বে কল্যান লেক রিসর্ট। তারপর সোজা রাস্তায় পড়বে হোটেল, রিসর্ট, লজ। ডানদিক দিয়ে ড্যামে যাওয়ার পথে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে মুরাড্ডি-বড়ন্তি ইকো টুরিজম। এটি একদম ড্যামের ধারেই।
বড়ন্তি’র কাছাকাছি অনেকগুলি ছোটোখাটো দেখার জায়গা রয়েছে যেগুলো খুব কম সময়েই একঝলক দেখে নেওয়া যেতে পারে।
বড়ন্তি ড্যামের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গোড়ঙ্গী পাহাড়। দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত বড়ন্তি পাহাড়।
বড়ন্তি’র কাছেই (দুই কিলোমিটার) মুরাড্ডি গ্রামের রাধাবিনোদের মন্দির একটি দর্শনীয় স্থান। রাধাকৃষ্ণের সোনার মূর্তি চুরি হয়ে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অষ্টধাতুর মূর্তি। পাঁচশত বৎসর ধরে এখানে রাস উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
সাঁতুড়ি থানার একটি প্রাচীন শিবস্থান হল হটনাগর শিবস্থান। যা বড়ন্তি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে কিনাইডি গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থিত। হটনাগর শিবমন্দিরটি পাতাল ফোঁড়।
বড়ন্তি থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত গাঙপুর গ্রাম। ঐতিহাসিক গ্রাম। পঞ্চকোটরাজ বলভদ্রশেখরের কনিষ্ঠ পুত্র বৈদ্যনাথশেখর গড় নির্মাণ করেছিলেন এই গাঙপুরে। তাঁর কীর্তি গাঙপুরের রঘুনাথ মন্দির।
বড়ন্তি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রামচন্দ্রপুর গ্রাম।
সাধারণ গ্রামের মতই একটি গ্রাম কিন্তু আজ গ্রামটি একজন মহাপুরুষের জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছে; সেই মহাপুরুষের নাম- অসীমানন্দ সরস্বতী।অসীমানন্দের প্রথম জীবনে নাম ছিল অন্নদাকুমার চক্রবর্তী।পরবর্তীতে অসীমানন্দ সরস্বতী।
এই বীর বিপ্লবীর সাথে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরঙ্গতা ছিল।সুভাষচন্দ্র এখানে এসেছেন। নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর অসীমানন্দ সরস্বতী’র সাথে।
আসানসোল-পুরুলিয়া রাজ্য সড়ক থেকে যে রাস্তাটি রামচন্দ্রপুর- মুরাড্ডি গেছে সেই পথটির নাম দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর নামেই। সুভাষ রোড এবং সুভাষ মোড়।
১৯৪০ এর ঘটনা।দুই বিপ্লবী একবার আসছিলেন মোটরগাড়িতে।হঠাৎই গাড়ির কাছে এসে পড়ে এক অন্ধ ব্যক্তি।নেতাজী গাড়ি থেকে নেমে ঐ অন্ধ ব্যক্তিকে বুকে জড়িয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে দেন।এরপর গাড়িতে বসেই অসীমানন্দজীকে বলেন- এদের জন্য কিছু করতে পারো?
নেতাজী অন্তর্ধান হলেন।দেশ স্বাধীন হোলো।অবশেষে নেতাজীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করলেন স্বামী অসীমানন্দজী।
১৯৫২ – তে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি চোখের হাসপাতাল
যা এখন পূর্ব ভারতের অন্যতম একটি চোখের হাসপাতাল।
নাম দেওয়া হয়েছে নেতাজীর নামেই। নেতাজী চক্ষু
হাসপাতাল। রামচন্দ্রপুর। ভারতবর্ষের দূর-দূরান্ত থেকে
প্রচুর নেত্র রোগীরা আসেন এখানে এবং উপকৃত হন।
হাসপাতাল সংলগ্ন রয়েছে স্বামীজীর জন্মভিটে যা শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ আশ্রম।আশ্রমে রয়েছে পাঠাগার, অনেক পুরোনো শিবলিঙ্গ, স্বামী অসীমানন্দের ধ্যানক্ষেত্র, বিশ্রাম কক্ষ,প্রাচীন বট গাছ ও স্বামীজীর স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন। খুব মনোরম শান্তির জায়গা।
বড়ন্তি’তে বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভালো লাগবে। নিরিবিলি হেঁটে হেঁটে ড্যামের ধারে ধারে ঘুরতে ঘুরতে মন ভালো হয়ে উঠবে। পাখিদের কোলাহল, রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে বড়ন্তি ঘোরা এক অদ্ভুত ভালোলাগা। পাহাড়ের ধারে ধারে বড় বড় পাথরে বসে নৈসর্গিক দৃশ্যপট ক্যামেরাবন্দী করতে কার না ইচ্ছে করে…….
ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে এই সুন্দরী বড়ন্তি।
পুরুলিয়া জেলার সাঁতুড়ি থানায় অবস্থিত ‘বড়ন্তি’
পর্যটন মানচিত্রে জনপ্রিয়তা হাসিল করেছে। কোলকাতা থেকে এর দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটার। আসানসোল থেকে ৩৭ কিলোমিটার। মুরাড্ডি রেলস্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার ও সুভাষ রোড মোড় থেকে ১০ কিলোমিটার।