ইতিহাস।।
(দশম শ্রেণীর চতুর্থ অধ্যায়)
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য লিখছেন ” নির্মলেন্দু কুণ্ডু মহাশয় ।।
✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️✍️
*ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য কী কী ? এই সংগঠনের উদ্যোগে পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিচয় দাও ৷* ৩+৫=৮
১৮৭৬ সালের ২৬ জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এক বিশাল জনসমাবেশে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হয় ৷ এই সভা ছিল মধ্যবিত্তনির্ভর ৷ এর সদস্যরা ছিলেন ব্যারিস্টার, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক প্রমুখ ৷ কৃষক শ্রেণী সম্পর্কে এই প্রতিষ্ঠান সচেতন ছিল ৷ এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলি হল—
১) দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা ৷
২) সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খাকে ভিত্তি করে ভারতের বিভিন্ন জাতি ও মতাবলম্বী গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা ৷
৩) হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা ৷
৪) জনসাধারণকে গণ-আন্দোলনে সামিল করা ৷
▫️▫️ভারতসভার আদর্শকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ঝঞ্ঝার মতো সমগ্র ভারত ভ্রমণ করে সর্বভারতীয় প্রচারকার্যে অবতীর্ণ হন ৷ তাঁর আদর্শে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্ণৌ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা সংগঠন গড়ে ওঠে ৷ জাতীয়তাবাদের জাগরণে ভারতসভা যেসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে, সেগুলি হল—
*কৃষক সমস্যা*— ভারতসভার সদস্যরা বাংলার নানা স্থানে ভ্রমণ করে বেশ কিছু কৃষক সভা স্থাপন করে কৃষকদের জমিদারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে যত্নবান হন ৷ ১৮৫৯ সালের রেন্ট অ্যাক্ট ও পাবনার কৃষক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এই সমিতি কৃষকদের পক্ষে আন্দোলনে নামে ৷ ১৮৮৪ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের খসড়ার বিরুদ্ধে এরা প্রতিবাদ জানায় ৷ এছাড়া সরকারের শোষণ, আমদানি শুল্ক আইন, সম্পদের বহির্গমন, আসামের চা বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধেও এরা প্রতিবাদ জানায় ৷
*সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত*— ভারতবাসী যাতে উচ্চতর রাজপদে নিযুক্ত হতে না পারে সেজন্য ১৮৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি লর্ড লিটনের শাসনকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করা হয় ৷ এর প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগেই ১৮৭৭-৭৮ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বোম্বাই ও মাদ্রাজে এই আইনের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয় ৷ এমনকি একটি সর্বভারতীয় আবেদনপত্র রচনা করে লালমোহন ঘোষকে দিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় ৷ শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা এই দাবির অধিকাংশ মেনে নিয়ে স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রবর্তন করে ৷
*অস্ত্র আইন ও মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন সংক্রান্ত আন্দোলন*— ১৮৭৮ সালে লর্ড লিটনের শাসনকালে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বা মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইন নামে দুটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন পাশ হলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ৷ এর দ্বারা একদিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় ও অন্যদিকে ভারতীয়দের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয় ৷ এসময় সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে নেটিভ প্রেস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় ৷ ১৬ এপ্রিল কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কলকাতার টাউন হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ৷ শেষ পর্যন্ত ১৮৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি লর্ড রিপনের আমলে এই আইনটি তুলে নেওয়া হয় ৷
*ইলবার্ট বিল আন্দোলন*— পূর্বে কোন ভারতীয় বিচারপতি কোন ইংরেজের বিচার করতে পারতেন না ৷ এই বর্ণবৈষম্য দূর করার জন্য লর্ড রিপনের পরামর্শে তাঁর আইনসচিব ইলবার্ট একটি বিল রচনা করেন, যাতে ইউরোপীয় ও ভারতীয় বিচারকদের সমমর্যাদা দান করা হয় ৷ এই বিল ইউরোপীয়দের মর্যাদায় আঘাত হানে ও তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসনের নেতৃত্বে ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে আন্দোলন চালাতে থাকে ৷ তখন সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভা এক প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে ও বিলের সপক্ষে প্রচার করতে থাকে ৷ শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকার কিছু শর্তসাপেক্ষে ভারতীয় বিচারকদের ইংরেজদের বিচার করার দায়িত্ব দেন ৷
*সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন*— সুরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন যে, সর্বভারতীয় কোন প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব নয় ৷ তাই ভারতসভার উদ্যোগে এবং সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহন বসুর চেষ্টায় কলকাতার অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানে কফি হাউস) জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় শতাধিক প্রতিনিধি নিয়ে ১৮৮৩ সালের ২৮-৩০ ডিসেম্বর এক সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন ৷ এর সভাপতিত্ব করেন রামতনু লাহিড়ী ৷ এখান থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয় ৷
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষে ভারতসভার অবদান সর্বাগ্রে স্মরণীয় ৷ একে অনেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বসূরী বলেছেন ৷ তাই ‘সাধারণী’ পত্রিকা ভারতসভা সম্পর্কে যথার্থই লিখেছিল, “….বহুদিন পর আবার ভারতসভার উদ্যোগে একত্রে (সর্বজাতি) গম্ভীর মন্দ্রস্বরে রাজনৈতিক সঙ্গীত পারিতে শিক্ষা করিল ৷”