আসানসোল দাঙ্গায় পুত্রহারা ইমাম পিতার শান্তির বার্তা
বটু কৃষ্ণ হালদার
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে দেশের হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন সমস্ত জাতি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিলেন। মিলিত জনগণের প্রচেষ্টায় কিন্তু রক্তের পিছল পথে এসেছিল স্বাধীনতা। এ কথা আমরা কিভাবে ভুলে যাব? স্বাধীন ভারতবর্ষ ছিল সর্ব ধর্মের মহা মিলন ক্ষেত্র। তাই দেশের সর্বোচ্চ অভিভাবক সংবিধানে মিলনের ভারতধর্ম নিরপেক্ষ শান্তির দেশ হিসাবে স্বকৃতি লাভ করে।তাই তো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার লাইন “মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, হিন্দু তাহার নয়নমণি, মুসলিম তাহার প্রাণ”, ভারতের আকাশে বাতাসে মধুর সুরে ধ্বনিত হয়েছে বারংবার, কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতির রং চড়িয়ে ধর্মের নামে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে ভারত ভূমির পবিত্র মাটি।
আসানসোলে রাম নবমী’কে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা হয় তাতে মারা যান মাওলানা হমদাদুল বশিদির ষোলো বছরের কিশোর পুত্র । নিজ পুত্রের নিথর দেহ দেখেছেন, মৃত পুত্রের জানাজাতে উপস্থিত হয়েছিলেন, জানাজাতে আগত মুসলিম ভাইদের চোখে মুখে প্রতিহিংসার যে আগুন তিনি দেখে ছিলেন, তাদের হাত থেকে অশান্ত আসানসোলকে তিনি বাঁচিয়ে ছিলেন। কিন্তু কেনো প্রশ্ন থেকে যায়?মৃত পুত্রের মাধ্যমিক এর মার্কশিট হাতে নিয়ে মাওলানা নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি আরও বার্তা দেন যে পয়সার অভাবে পড়াশুনা করতে পারছেনা যারা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াও, কখনও ধর্ম দিয়ে শুধু ছাত্র ছাত্রী নয় কোনো মানুষকে বিচার করো না।
কিন্তু প্রশ্ন এর জন্যে দায়ী কারা?
ধর্মের নামে চলছেই প্রহসন ও প্রতিযোগিতা মূলক লড়াই। সাম্প্রদায়ীক উস্কানিতে বাংলা তথা পবিত্র ভারতের মাটি কলঙ্কিত ও দূষিত হচ্ছে বারংবার, এর আগেও সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, বেলুচিস্থান, পাকিস্তান, থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, মায়ানমার, তথা ভারতবর্ষ সহ বিভিন্ন দেশ সাম্প্রদায়ীকতার রক্তে নিজেদের হাত রাঙিয়েছে, এর জন্যে অবশ্যই দায়ী নোংরা রাজনীতি, এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে প্রতিনিয়ত, নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির বাসনায় ও ক্ষমতা কায়েম করতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি মূলক বক্তব্য পেশ করে জনসমক্ষে আর নিজ ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে নির্বোধ জনগণ মেতে ওঠে রক্ত পিপাসু খেলায়, আর সমাজের সেই সব স্বার্থানেষী হায়নারা যবনিকা নামক পর্দার আড়ালে দাঁত খিচিয়ে হাসে, ভাই ভাইয়ের রক্ত ঝরতে দেখে উল্লাস করে। দাঙ্গার কোনো জাত বা রং হয় না এটা কিন্তু আমরা সবাই জানি এতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন আবাল, বৃদ্ধ, শিশু, নারী, ঘর, দোকান গাড়ি, মন্দির মসজিদ থেকে শুরু করে অনেক প্রাচীন স্থাপত্য, নিদর্শন। শুরু হয় ক্ষতিপূরণের পালা, সরকার যা ক্ষতি পূরণ দেয় তা সাধারণ জনগণের থেকে নেয়া করের টাকা আমরা আর কবে এই ভাষাটা বুঝতে পারব জানিনা।
পবিত্র ভারতের মাটিতে এর আগে নোদাখালি গুজরাটের গোধরা কান্ডতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছিল সে ইতিহাস জনগণ আজও ভুলে যায় নি। কিন্তু সবথেকে লজ্জার বিষয়, সভ্যতা যত এগোচ্ছে মানুষ ততই বর্বর, হিংস্র হয়ে উঠছে।বেড়েই চলেছে ধর্মের হানাহানি। সাধারণ জনগন বর্তমানে রামনবমীকে কেন্দ্র করে আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্তের ইতিহাস মাথা চাড়া দেয় পুরুলিয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল, আলিপুরদুয়ার, নিউটাউন, ধুলা গড়, উলুবেড়িয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলা গুলিতে. রামনবমী উপলক্ষে সশস্ত্র অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিল বার করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, আসানসোলে সশস্ত্র শোভাযাত্রায় প্রকাশ্যে গুলির লড়াই, বোমাবাজিতে ডান হাত উড়ে যায় ডিসি (সদর) অরিন্দম দত্ত চৌধুরীর এবং তৎসহ অনেক পুলিশ কর্মীরা আহত হন।
পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে চাঁদমারি এলাকা দিয়ে যখন রামনবমীর মিছিল যাচ্ছিল তখন তাদের উপর ইট পাটকেল ছুড়ে মারা হয় হিন্দুরা দাবি করেন অপর দিকে মুসলমানরা বলেন তাদেরকে পাকিস্তান চলে যাবার স্লোগান দেয়া হয় এই ভাবে একে অপরের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চাঁদমারির এই এলাকায় রেল পাড়ের এক দিকে হিন্দু অন্য দিকে ছিল মুসলমানদের বসবাস. বহু দিন ধরেই একে অপরের সাথে মিলে মিশে বসবাস করে চলেছে. এর আগে এমন দৃশ্য কখনও তারা দেখেননি তবে এতে রাজনৈতিক দলের উস্কানি মূলক মদত রয়েছে তা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রথম খবর দাঙ্গা, হাঙ্গামা, খুন জখমের মাঝে রাজনৈতিক নেতারা ঘোলা জলে নিজেদের হাত পাকিয়ে নেবার জন্য তৈরি হতে থাকে কিন্তু সব কিছুকেই ছাপিয়ে খবরের শিরোনামে এলেন দাঙ্গায় নিহত এক সন্তান হারা ইমাম পিতা।
রাম নবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামার দৃশ্য। অশান্ত আসানসোলে আরও ভয়াবহ সংঘর্ষ বেধে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে ওঠে কারণ ওই দাঙ্গায় নিহত হন ওখানকার মসজিদের ইমামের পুত্র। তার জানাজায় জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার মুসলিম প্রতিশোধ নেবার জন্য কিন্তু সমস্ত উত্তেজনায় জল ঢেলে দেন সন্তান হারা এক ধার্মিক পিতা. তিনি বলেন “আমি শান্তি চাই, এই মৃত্যুর শোধ তুলতে গিয়ে একটি ঘরে আগুন না লাগে, কোনো জিনিস যেনো ভাঙচুর না হয় একটি সন্তান আর যেনো না মরে, আমি রক্ত চাই না,” তিনি আরও বলেন “আমার সন্তানের আসা
যাবার দিনক্ষণ আগে থেকে ঠিক হয়েছিল, জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু নিশ্চিত, তার আয়ু ফুরিয়েছে,
তাই আল্লাহ তাকে তুলে নিয়েছে আর যারা তাকে হত্যা করেছে আখেরি কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের বিচার করবে সাজা দেবে “কাজেই আমি আল্লাহ উপর ছেড়ে দিয়েছি। মাওলানা রশিদি জমায়েত মুসলমানদের জানিয়ে দেন যদি এই কথার কোনো অন্যথা হয় তবে তিনি মসজিদের ইমামতি ছেড়ে আসানসোল ত্যাগ করবেন, তিনি আরও বলেন” নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিকে আমি ভুলে যেতে চাই আসানসোলের জনগণ এমনটা নয়, এটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
আসানসোলের মেয়র জীতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, উত্তেজিতদের শান্ত এবং প্রশাসন কে সহযোগিতা করেছেন ইমাম। আমরা আজ গর্বিত। নিজের সন্তানকে হারিয়েও তিনি যে বার্তা দিয়েছেন তা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী দেশ গুলিতে মানব প্রেম ও শান্তির বার্তা হিসাবে বিশ্ব দরবারে আলোচিত হোক।
দাঙ্গায় নিহত পুত্রহারা ইমাম পিতার এই শান্তির বাণী বিশ্বের দরবারে সম্প্রতির বার্তা হিসাবে ছড়িয়ে পড়ুক এটা আমরা সবাই চাই। তিনি সন্তান হারিয়েও পেয়েছেন মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা, যারা আজ এই অপকর্ম করেছে তাদের বিবেক বোধ কুরে কুরে খাবে। সমস্ত সন্ত্রাসবাদীরা মর্মাহত হয়ে বুঝতে পারবে যে ধর্ম কথার অর্থ হলো শান্তি, প্রেম, ভালোবাসা, হত্যা বা রক্তপাত নয়।
আমরা সবাই আজ ইমামের দীর্ঘ জীবন ও তার মৃত পুত্রের আত্মার কামনা ছাড়া আর কি বা করতে পারি? আমাদের বিশ্বাস বর্তমান অস্থির সমাজের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে সমস্ত মায়েরা আজ ইমামের মত পুত্র সন্তান গর্ভ ধারণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ধর্ম মানে নিজ ধর্মকে রক্ষা ও অন্য ধর্মকে সন্মান করা
রামনবমীর মত কোন ধর্মে প্রকাশ্যে সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক মিছিল প্রতিযোগিতা কাম্য নয়। অস্ত্র মিছিল যাতে বন্ধ হয় তা যত শীঘ্র সম্ভব বন্ধ করাটা সমাজ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার, নয় তো এই সমাজ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে, সুস্থ বিকাশের চিন্তা ধারা থমকে যাবে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে।
বিগত দুই বছর যাবত অতিমারির প্রভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল বিশ্বের হৃদপিণ্ড। লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছিল ধর্মের স্থান। মুক্তির একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষা। তখন কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরিষেবা, খাদ্য কোন কিছুই ধর্মস্থান দেয়নি। অতিমারি যে শিক্ষা আমাদের দিয়ে গিয়েছিল, তা উপেক্ষা করে চলছে ধর্মের প্রতিযোগিতা। অথচ দিনে দিনে ধর্মস্থানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু তাতে কি আমরা প্রকৃত ধার্মিক হতে পেরেছি? প্রকৃত ধার্মিকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বিলুপ্ত হচ্ছে মানবিকতা। মানব সেবার নামে চলছে লুটোপুটি খেলা। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে মাৎস্যন্যায়। যে ধর্ম হাত বাড়িয়ে দেয়, বুকে জড়িয়ে আপন করে নেয় সেই ধর্মের নামে চলছে মানব হত্যা। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষের সংস্কৃতি তো অন্য কথা বলে। এদেশে যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করেছে এবং তার সঙ্গে উভয়ের ধর্ম পালন করে আসছে। হিন্দু বোনকে কন্যাদান করে মুসলিম ভাই, মুসলিম ভাই হিন্দু বোনের বাড়িতে ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছে সে সংস্কৃতি তো আমাদের কাছে নতুন নয়। ভিন্ন ধর্ম হয়েও বন্ধুর জন্য রক্ত দিতে আসে। ভাবুনতো কেরালার কথা।কেরালায় বন্যা হওয়ার পর কাদা নোংরা জলে ডুবে থাকা মন্দির পরিষ্কার করেছে মুসলিমরা।আবার হিন্দুরা মসজিদ পরিষ্কার করেছে। তাই আমাদের সবার চোখে ঈদ, দুর্গাপূজা আলাদা নয়। এটাই ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি।
পশ্চিমবঙ্গ সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্যর বাহক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এমন ইতিহাস পৌরাণিক, কাল্পনিক, মহাকাব্য, ধর্মীয় গ্রন্থ কলঙ্কিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। কিন্তু আজ তার অবমাননা ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। এই বাংলা এই জন্মভূমি তোমার আমার সকলের। বন্ধ হোক ধর্মের নামে অস্ত্রের কারসাজিতে রক্তের হোলি খেলা। ধর্ম, জাতি, ভাষা, নির্বিশেষে হোক সব জায়গায় সম্প্রীতির মেলবন্ধন। জাত, ধর্ম নির্বিশেষে দল বেঁধে হোক প্রভাত-ফেরির গান। আগামী দিনে ধর্ম নিয়ে সশস্ত্র মিছিল বন্ধ হবে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের কাছে এই আহবান করি মিলে মিশে এক আত্মায় আত্মহারা হয়ে থাকবো যতো দিন এ দেহে রহিবে প্রাণ। তাই রাজনৈতিক কারসাজিকে উপেক্ষা করে এ সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। কোন রাজনৈতিক প্রলোভনে পা দিয়ে আমরা ভাই ভাইয়ের রক্তে হাত রঙিন করে তুলবো না এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত।
বটু কৃষ্ণ হালদার,