আরব,আফগান,তুর্কিও মুঘলরা ভারতে আসার পরে আর আরবীয় কালচার ধরে রাখতে পারেনি বা রাখার চেষ্টা করেনি ভারতীয় হয়ে গিয়েছে এবং ভারতের কৃষ্টি সাথে মিশে গিয়েছে।
মোঃ মাইনুল ইসলাম
তাং26/03/2022
সমস্ত মধ্যযুগ ধরে মুসলমানরা হিন্দুর ধর্মীয় সাহিত্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য প্রচুর কষ্ট স্বীকার করে। উল্লেখযোগ্য প্রায় সব রচনাই তারা ফারসি ভাষায় অনুবাদ করে। যেমন বেদ, উপনিষদ,মহাভারত,রামায়ন,ধর্মশাস্ত্র,পুরান,যোগাবাশিষ্ঠ,যোগশাস্ত্র ও বেদান্তশাস্ত্র।
সামাজিক ভাবে ভারতীয় মুসলমান হিন্দুদের মতো একটি সংগঠনের বিকাশ ঘটায়। ভারতে মুসলিম সমাজ হিন্দু – জাতি প্রথার মতো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছে, যা প্রাসঙ্গিক আয়াত (বাক্যামালা) পাঠ করে কাজি সাহেব বর- কনেকে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করতেন। বালিকাদের বাল্য বিবাহ,বিধবা বিবাহের নিষেধাজ্ঞা, নারীর পরমুখাপেক্ষিতা ও অধীনতা এবং পর্দার ব্যবহার হিন্দু -মুসল মানের মধ্যে সাধারণ ছিল।
মুসলিমরা হিন্দুর অনেক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রকরণ গ্রহন করে। যেমন, তিজা,দশওয়ান ইত্যাদি। তারপর গর্ভ ও সাধ, শিশুষষ্ঠী, শিশুর মাথা কামানো ( মুণ্ডন বা আকিকা, মুসলিম ধর্মেও এটা আছে), ক্ষীর চাটানো, কান ফুটো করা, জন্মবার্ষিকী পালন ইত্যাদি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ ছিল।
একটি সমাজের স্তর ও শ্রেণিবিন্যাসে, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধের –বাছবিচার ও বাক সংযমের অন্ত প্রকৃতির সবচেয়ে বৈশিষ্টপূর্ণ অভিব্যক্তি হল পোষাক। এই দৃষ্টিকোন থেকে লক্ষণীয় বিষয় হল- ভারতীয় মুসলিমরা ব্যাপক হারে আরব, ইরাণ ও মধ্য এশিয়ার পোষাক ছেড়ে প্রধানত ভারতীয় পোষাক-পরিচ্ছদ অঙ্গে তুলেনেয়। আরবী আমামা (পাগড়ি),জুব্বা, রাদাহ ,তাহমদ ও তাসমা এবং মধ্য এশিয়ার কুলাহ, , নিমা, মোথা ইত্যাদির ব্যবহার বন্ধহয়ে যায়। আর তার জায়গায় আসে হিন্দু পাগড়ী ও চিরা, কুর্তা ও আঙ্কারা, পটকা ও দোপাট্টা, পাজামা ও জুতা।
এই ধরনর বাহ্যবস্তু থেকে জীবনের সংস্কৃতিক উপকরনের দিকে মুখ ফেরালে আমরা দেখতে পাবো সেখানেও রয়েছে সেই একই সমীভবন। ভারতে একটি সর্বজনীন সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে
মুসলিমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা বিবেচনা করা যাক। মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষার কথাই ধরা যাক, কেননা ভাষাহল বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রাণশক্তি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। আরবী, ইসলামের পবিত্র ভাষা। আর গোড়ার দিকের সিন্ধু – অভিযান কারিদের মাতৃ ভাষাও ছিল আরবী। এটি বর্তমানে ভারতের কোনো মুসলিমের মাতৃভাষা নয়, যদিও বিভিন্ন কারণে শিক্ষিত মানুষ এটি অধ্যয়ন করে থাকেন।মধ্য এশিয়ার মুসলিম বিজেতাদের কথ্যভাষা ছিল তুর্কি : মুসলিম শাসনের শুরু থেকে শেষ বিপর্যয় পর্যন্ত ফার্সি ছিল সরকারি ভাষা। ভারতের মুসলমানরা এখন এর একটা ভাষাতেও কথা বলেনা। বিজেতারা বিজিতের ওপর সেগুলি চাপিয়েও দেয়নি।
মুসলিমরা বরং ভারতীয় ভাষা গ্রহন করে। আর নিজেদের ভাষা থেকে শব্দ এনে তাকে সমৃদ্ধ করে। পাঞ্জাবের মুসলমান পাঞ্জাবি বলে, বাংলার মুসলমান বাংলা বলে, গুজরাটের মুসলমান গুজরাটি বলে। অর্থাৎ তারা যে অঞ্চলে বসবাস করে সেই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে। আর কথা বলার ধরনে হিন্দু ও তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।খাদ্য গ্রহন করার ক্ষেত্রেও যে অঞ্চলে বসবাস করে সেই অঞ্চলের খাদ্য গ্রহনে অভ্যস্ত হয়েছে। সুস্বাদু খাবার বানানোর প্রায় সকল মশলা তাদের হাতধরে আসে বা তাদের আবিস্কার। তারপরেও তারা তা আঁকড়ে ব’সে থাকেনি বরং ওই অঞ্চলের সকল বিষয়কে আত্মস্থ করেছে। প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন, সম্প্রদায় গত দিক দিয়ে হয়তো খুব অনুবীক্ষন সংখ্যা লঘু ছাড়া, হিন্দুর থেকে ভারতের মুসলমানের পুরোপুরি পার্থক্য নির্নয় করা যায়না। প্রাচীন আরব, তুর্কি,ও পারসিকদের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। মুহাম্মাদ -বিন-কাশিমের নেতৃত্বে যেসব আরব সৈনিক সিন্ধু আক্রমন করে বা যে সব আরব গোত্র একশো বছর ধ’রে সিন্ধু উপত্যকা শাসন করে,সিন্ধু জনপদে তাদের পদচিহ্ন শনাক্ত করা অসম্ভব। গজনভী, ঘোরী, মুঘল, তুর্কি ও আফগানদের পায়ে পায়ে মধ্য এশিয়ার যে সব গোত্র ভারতে প্রবেশ করে ও যাদের উত্তর পুরুষ পাঁচশো বছরেরও বেশি শাসনকর্তৃত্ব বহাল রাখে, তারাও অনুরুপভাবে সম্পূর্ণই অন্তর্হিত হয়েছে। মুসলিম বিজেতারা তাঁদের সম্প্রদায়গত পরিচয় বা গোত্রীয় সংগঠন ধ’রে রাখতে পারেননি। ভারতের আম জনতার সাথে নিজেদের মিশিয়ে দিয়েছেন ।মুসলিম শাসন পঞ্জীতে উপজাতি, গোত্র ও গোষ্ঠীর যে নামগুলো এত কোলাহলমুখর, বর্তমানে তারা খুব অল্পই পরিচিত আর বিস্মৃত প্রায়। সমীভবনের প্রক্রিয়া চলেছে অবিরাম, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে। ধর্মান্তর, বিবাহ, আর দেশে ফেরার বা মাতৃভূমির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার অভিপ্রায় শূন্য ভারতবাষী। দেশকে ভালোবেসে দেশের কৃষ্টি-কালচারের সাথে মিশে যাওয়া দেশ প্রেমিক । দূর করেছে তাদের পার্থক্য, এনে দিয়েছে সম্প্রদায়গত সাযুজ্য।
তথ্যসূত্র :
১)হিন্দু মুসলিম প্রব্লেম, ডঃ তারাচাঁদ। ২) এশিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া, হাভেল। ৩) ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি, ডঃ বি. এন. পান্ডে পৃষ্ঠা নং 58 – 64 #