কবি দিলীপ কুমার গরানী হাওড়া জেলার বেনাপুর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় প্রযুক্তিবিদ। বড়ো হয়েছেন সাহিত্যিক পরিমন্ডলে। ছোট থেকেই লেখার সাথে যুক্ত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে বা হচ্ছে। শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে তার প্রথম কাব্যগ্রন্হ।
ছোট গল্প : অমরত্ব
——–
কলমে- দিলীপ কুমার গরানী
**********************
সুরেশবার বয়স এখন পঞ্চাশ বৎসর। তিনি একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। গাড়ি বাড়ি অর্থ সম্পদ কোনো কিছুরই তার অভাব নেই। ঘরে অতীব সুন্দরী স্ত্রী,
তিনজন পুত্র।
কন্যাকেও খুব ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে পাত্রস্থ করেছেন। তিনটি পুত্রের বিবাহ এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে। তাই নিয়ে সংসারে অশান্তির কোনো চিহ্ন মাত্র ছিল না। যদিও ছেলেদেরও প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন বড় বড় ব্যবসা করে দিয়েছেন। মোট কথা সুখের প্রাচুর্যে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু ইদানিং তিনি ভাবতে লাগলেন, এত সুখ তো চিরদিন থাকবে না,কিছুদিন পরে তো এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে।
জীবের তো আর অমরত্ব নেই। এবার তিনি ভাবতে শুরু করলেন,
যে কঠিন সাধনা করে ভগবানের কাছ থেকে অমরত্ব প্রার্থনা করলে কেমন হয়। অসুরেরা তো এইভাবেই দেবতাদের কাছ শর্ত সাপেক্ষে অমরত্ব বর পেয়েছিল। এরপর তারা না হয় দেবতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা জাহির করেছিল তাই তাদের পতন হয়েছিল। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করবেন না তাহলে তো আর তার অমরত্ব সহজে হাতছাড়া হবে না। এই অর্থ সম্পদ চিরদিন
তিনি ভোগ করবেন, শুধু কিছুদিন সাধনা করলেই তো হলো। ভগবানের একবার দেখা পেলেই সব ল্যাটা চুকে যাবে। তারপর ভগবানের সঙ্গে সুপারিশ করে অমরত্ব বর চাইলেই তো হলো। তাই কিছুদিন পরেই কাউকে কিছু না বলে হিমালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কারণ হিমালয়কেই তপস্যা করার আদর্শ জায়গা বলে তিনি মনে করলেন। খুব দ্রুত বিশেষ বিমানে চেপে হিমালয়ে
পৌঁছলেন। তারপর হিমালয়ের পাদদেশে গভীর তপস্যা শুরু করলেন।
সুরেশবাবু গভীর তপস্যায় নিমগ্ন হয়ে,
দিন রাত ভগবানকে ডেকেই চললেন। ব্যাপারটা ভগবানেরও চক্ষু এড়ালো না। তিনিও খুব আশ্চর্য হলেন। একজন ধনী ব্যক্তির অমরত্ব লাভের জন্য এত ভক্তি, এত আত্মত্যাগ তাহাকে
যারপরনাই বিস্মিত করল। তিনিও ওই ধনী ভক্তের কষ্ট বেশীদিন
সহ্য করতে পারলেন না। তাই তপস্যার মাত্র পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হতেই তিনি সশরীরে সুরেশবাবুর সম্মুখে উপস্থিত হলেন। ভগবান বললেন, ” বৎস, আমি তোর তপস্যায় প্রীত হয়েছি, বল কি বর চাস?”
সুরেশবাবু ধীরে ধীরে নয়ন উন্মীলিত করলেন। অবাক বিস্ময়ে ভগবানের জ্যোতির্ময়
রূপ পরিদর্শন করলেন। আর
সত্যিই ভগবানের দেখা
পাওয়ার জন্যে খুবই আনন্দিত হলেন, কিন্তু আপন অভীষ্ট লক্ষ্য হতে পিছপা হলেন না। তারপর ভগবানের পাদপদ্মে মাথা
ঠুকে বললেন, ” প্রভু, আমায় অমরত্ব বর প্রদান করুন।” ভগবান বললেন,” অন্য বর চেয়ে নে বৎস। কারণ প্রত্যেক জীবই মরনশীল। এমনকি আমিও মনুষ্য জন্ম নিয়ে
মৃত্যু বরণ করেছিলাম। সুরেশবাবু
বললেন, না প্রভু অমরত্ব বরই আমার একমাত্র কাম্য।তখন ভগবান সুরেশবাবুর নাছোড়বান্দা
মনোভাব দেখে বললেন,”ঠিক আছে অমরত্ব বরই দিতে পারি কিন্তু শর্তসাপেক্ষে।। সুরেশবাবু বললেন, ” ঠিক আছে,বলুন, আপনার কি শর্ত।”
ভগবান বললেন, ” অমরত্ব ততদিনই বজায় থাকবে যতদিন না তোর দুঃখের অশ্রু মাটিতে পড়বে। সংসারের স্বাভাবিক নিয়মে তুই দুঃখ পেতেই পারিস কিন্তু ওইটুকুই, কোনো
অবস্থাতেই যেন তোর পৌরুষত্ব মাটিতে গড়াগড়ি না যায়।”
সুরেশবাবু বললেন, ” সত্যি বলছি প্রভু। আমার দুঃখের কোনো প্রশ্নই নেই, আমার অঢেল অর্থ সম্পদ বাড়ি গাড়ি সবই আছে, যা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সুখ কেনা যায়। চোখের জল তো অনেক পরে।”
ভগবান একটু মুচকি হাসলেন, তারপর বললেন, ” তথাস্তু বৎস, এবার তুই ঘরে ফিরে যা।”
পাঁচবৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যেই সংসারের অনেক কিছু
বদল হয়েছে। তিনটি ছেলেরই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। পিতার ব্যবসা, যা কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা, তিনভাই
সেরে ফেলেছে। জন্মদাত্রী মাকে ভাগের মা বানিয়ে তারা তাদের স্ত্রীদেরও একটু শান্তি দিয়েছে। যেহেতু তিনজন স্ত্রী, একটি বিষয়ে একমত ছিল তাদের শাশুড়িমাই সংসারে যত অশান্তির মূল কারণ।
এদিকে দীর্ঘদিন অনশনের ফলে সুরেশবাবুর শরীরও অস্থিচর্মসার অবস্থায় পৌঁছেছে। মুখে একগাল বটবৃক্ষের ঝুরির মতো লম্ব লম্বা দাড়ি গোঁফ। পরনে দীর্ঘদিনের ছিন্নভিন্ন গন্ধযুক্ত কাপড়, এমতাবস্থায় একদিন সন্ধ্যাবেলায় চুপি চুপি সবার অলক্ষ্যে একেবারে শোবার ঘরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, “সবু আমায় চিনতে পারছ?” আসলে সুরেশবাবু ভালোবেসে নিভৃতে বউকে সবু বলে ডাকতেন।তার স্ত্রী র আসল নাম ছিল সবিতা। সুরেশবাবুর এই হঠাৎ অনভিপ্রেত প্রত্যাবর্তনে তার স্ত্রী একবারে হকচকিয়ে গেলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, ” চোর, চোর, ওরে কে কোথায় আছিস, আমার ঘরে চোর ঢুকেছে।” সুরেশবাবু যত তার
স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে তিনি অযথাই চিৎকার করছেন, আদপে তিনি তার স্বামী। তার স্ত্রীর চিৎকার তত চড়া সুরে বাজল।অবশেষে যা হবার তাই ঘটল, দাস দাসী তিন বৌমা মূল রাসমঞ্চে প্রবেশ করলেন, যেখানে এতদিন তিনি প্রেম নিবেদন করেছেন তা আজ যেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হলো। যদিও সেই বিশেষ মুহুর্তে তার তিন পুত্র
অনুপস্থিত ছিলেন , তাহলে যে কি ঘটত তা কে জানে! তবে এ যাত্রায়
শতাধিক বেদনাতেও তার পৌরুষত্ব বজায় থাকল। অবশেষে দেহের কোনো এক বিশেষ চিহ্ন দেখে তার স্ত্রী সনাক্ত
করলেন যে এটাই তার অপদার্থ স্বামী।
তাই শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ঘরেরই এক কোণে জেলের কয়েদির মতো কোনোরকম একটু ঠাঁই পেলেন। তবে এতদিনের দাম্পত্য জীবনের সুখ এই পাঁচ বৎসরের বিচ্ছেদে প্রায় পুরোপুরি ইতি পড়ল। রাগে, দুঃখে, সুরেশবাবুর স্ত্রী নিজেকে শামুকের মতো অভিমানের শক্ত খোলসে ঢেকে রাখলেন। সুরেশবাবুর এত দিনের চেনা সংসারটা কেমন যেন ভিন্ন রূপে তার হৃদয়কে হাতাশার বাণে বিদ্ধ করল। তবে একেবারে ভেঙে পড়লেন না।
পরের দিন সকালে সুরেশবাবুর তিন পুত্রের কেউ পিতার এই অনভিপ্রেত আগমনে খুশি হলেন না। এমনকি কেউ পিতার এতদিনের অর্জিত অর্থ সম্পদ ভাগ বাটোয়ারাতেও রাজী হলেন না।
তিন পুত্রের এই অমানবিক আচরণে সুরেশবাব খুবই বিস্মিত হলেন। কিন্তু এরপরেই ভাবলেন যে তিনি অমরত্ব বর অর্জন করেছেন তাই
ক্ষণজীবী পৃথিবীতে তার এত অস্থিরতা মানায় না। একটু একটু করে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ঠিক বিকালেই তার একমাত্র মেয়ের আগমন তাকে একটু খুশির অনুভূতি দিয়েছিল বটে, কিন্তু বিদায়কালে মেয়ে বলল, ” বাবা, তুমি আমাকে
বাচাও। দাদারা যেদিন থেকে নিজেদের মধ্যে তোমার সব অর্থ সম্পদ ভাগাভাগি করেছে, সেদিন থেকেই আমার শ্বশুরবাড়ীর প্রতিটি সদস্য প্রতিদিন আমাকে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করেই চলেছে, বাপেরবাড়ির সম্পত্তির ভাগ আনার জন্যে। তোমার অনুপস্থিতিতে দাদাদের অনেকবার সেকথা বলেছি, কিন্তু দাদারা সে কথায় কোনোদিন কর্ণপাত করার তাগিদ
অনুভব করেনি। তুমি অন্তত আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়ো না। তাহলে এরপর আমার আর মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না বাবা।” এই বলে তার একমাত্র মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সুরেশবাবু মেয়ের মুখে শ্বশুররাড়ীতে তার হেনস্থার কথা
শুনে মানসিকভাবে খুব মুচড়ে পড়লেন। তারপর মেয়ের দু- চোখ মুছিয়ে বললেন, ” আজ আমি কপর্দকশূন্য। আমার তোকে দেওয়ার কোনো অর্থই নেই। তবে জামাইকে আর কিছু দিন অপেক্ষা করতে বল। আমি
তোর দাদাদেরকে বলে কিছু একটা ব্যাবস্থা করব মা। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সুরেশবাবু কোনক্রমে ক্রন্দনরতা মেয়েকে বিদায় দিলেন কিন্তু নিজে অমরত্বের শর্তানুযায়ী একটুও কাঁদতে পারলেন না। এ কষ্ট যে কতখানি তা বোধহয় এই পৃথিবীতে সুরেশবাবুই কেবলমাত্র বুঝলেন। পরেরদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে, সুরেশবাবু
তার সন্তানদের মেয়ের করুণ অবস্থার কথা জানিয়ে কিছু একটা সুরাহার ব্যবস্থা করতে বললেন। কিন্তু তার তিন গুনধর পুত্রই কোনো উত্তর না দিয়ে নির্বিকারভাবে সেই স্থান পরিত্যাগ করলেন। শুধু তাই নয় এরপর সংসারে তার জন্য সামান্য যেটুকু অন্নসংস্থানের
ব্যবস্থা ছিল তাও বন্ধ হলো। বাড়ির এক পুরানো চাকর নিজে
না খেয়ে লুকিয়ে পুরানো মনিবের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করল। এত দুঃখের মধ্যেও সুরেশবাবুর চোখের জল কিন্তু চোখের মধ্যেই বাঁধা ছিল।
কন্যার শ্বশুরবাড়ী গমনের ঠিক দিন দুয়েক পরেই হঠাৎ সকালবেলায় জামাই ফোন করলেন,” বাবা আপনার মেয়েকে
দেখে যান, ও সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ।” সুরেশবাবু কালবিলম্ব না
করে তৎক্ষণাৎ মেয়ের শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। সেখানে পৌঁছে দেখলেন গোটা বাড়িতে লোকজন থই থই করছে। একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে সুরেশবাবু ভিড় সরিয়ে মেয়ের একেবারে সামনে উপস্থিত হলেন।
এরপর যা দেখলেন, তা দেখে কোনো পিতার পক্ষেই চোখের জল ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে,
সুরেশবাবুও ব্যতিক্রমী হতে পারলেন না। তিনি তার একমাত্র
কন্যার ফুলের মতো মুখটাকে অ্যসিডে পোড়া,ও সারাদেহটাকে
ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় দেখে আর দু- চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। এবারে কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় সুরেশবাবু পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন। এরপর সুরেশবাবু দারুণ শোকে বিহ্বল হয়ে মেয়ের নিথর দেহের বিকৃত মুখে
মুখ রেখে, উচ্চইঃস্বরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বললেন,” হায় ঈশ্বর! আমি অমরত্ব চাই না। আমাকে
মুক্তি দাও প্রভু,আমাকে মুক্তি দাও।”
ঈশ্বর চুপিচুপি অদৃশ্য হয়ে সুরেশবাবুর কানে কানে বললেন,
“অর্থ সম্পদ মানুষকে সুখ বা দীর্ঘজীবন কোনোটাই দেয় না, সৎসঙ্গেই মানুষ সুখ আর দীর্ঘজীবন দুটোই
লাভ করে।”