Spread the love

অনুগল্প ‘ইচ্ছে’

প্রীতম সরকার

 

বাড়ির কাছের মোড়ে টোটো নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল উত্তম। স্কুল যে খুলে গিয়েছে, সে কথা সে জানে। ক্লাস নাইনের ছাত্র সে। গত দু-বছর করোনার কারনে স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস বা পরীক্ষা হয়নি। ক্লাস সেভেনের ছাত্র যখন ছিল, সেসময় নিয়মিত স্কুলে যেত সে। কি আনন্দই না স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে করতো!
কিন্তু তারপরে যে কি হলো! চারদিকে সব বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলেও ছুটি ঘোষনা হলো। গভীর রাতের মতো দিনের বেলাতেও সব রাস্তা-ঘাট খাঁ খাঁ করছে। সবাই বলাবলি করছিল, বাইরে বের হলে নাকি করোনা রোগে ধরবে।
বাবা মুম্বইতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করতেন। মুম্বই থেকে লকডাউনের সময় হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় মারা গিয়েছেন। তারপর থেকে পরিবারে নেমে এলো অভাব! মা বিড়ি বেঁধে যেক’টা টাকা রোজগার করতেন, সেই টাকায় দুই ভাইকে নিয়ে সংসার চালাতে পারছিলেন না। স্কুল থেকে কিছু চাল,ডাল, সাবান দিত ছাত্র পিছু। মা স্কুলে গিয়ে সেটাও নিয়ে আসতেন।
এখন লকডাউন উঠে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। মানুষজনও আগের মতোই রাস্তায় বের হচ্ছেন। কিন্তু উত্তমের স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। হবেই বা কি করে! সে যে এখন একজন টোটো চালক।
মোড়ের মাথায় ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করার সময় পুরানো দিনের স্মৃতিগুলিই মাথায় ভিড় করে আসছিল উত্তমের। স্কুলে না যেতে পারলেও, পড়াশোনা কিন্তু উত্তম ছেড়ে দেয়নি। স্কুল খোলার আগেই বইপত্র জোগাড় করে দিয়েছিলেন স্কুলের বাংলা শিক্ষক সুনীলবাবু। সেই বই নিয়েই রাতে বাড়িতে ফিরে সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও পড়তে বসে উত্তম।
টোটো চালিয়ে রোজগার যা করছে, তাতে সংসার কোন মতনে চলে যাচ্ছে।
‘এই টোটো ভাড়া যাবে?” প্রশ্ন শুনেই ঘুরে তাকালো উত্তম।
যে টোটোটি ভাড়া নিতে এসেছে, সে তো তাঁর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়াশোনা করে! সুজয় হেসে তাকিয়ে বলে, “অবশ্যই যাবো! কিন্তু ভাড়ার সঙ্গে আরও একটু বেশি কিছু দাবি করবো কিন্তু!”
ততক্ষনে টোটোতে উঠে বসেছে সুজয়। সে হেসে উত্তমকে জবাব দেয়, “জানি তো ! ভাড়া বাদে তোর দাবি কি! সেটাও মিটিয়ে দেবো।”
আর অপেক্ষা না করে একজন সাওয়ারিকে নিয়েই স্কুলের রাস্তায় টোটো চালিয়ে দেয় উত্তম। স্কুলের সামনের গাছের ছাওয়াতে সুজয়ের কাছ থেকে গত কয়েক দিনের স্কুলে কি পড়ানো হয়েছে, বুঝে নিতে হবে যে!

*********************************

কবি প্রিতম সরকার: লেখকের জীবনপঞ্জী-

প্রীতম সরকারের জন্ম উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ শহরে। বিজ্ঞানের স্নাতক। লেখালেখির শুরু ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে আঁকা শিখতে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক অসুবিধার কারনে সেই শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায়। তার আগেই সঙ্গীতে বিশারদ ডিগ্রি লাভ। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ইংরাজি এবং বাংলা কাগজে কার্টুনিষ্ট হিসাবে কাজে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতা শুরু করেন। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন আনন্দ বাজার পত্রিকা এবং হিন্দুস্থান টাইমস্‌ কাগজে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক। এখন নিয়মিত ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অনুগল্প, উপন্যাস লেখেন। মোট প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ছয়। ‘মিলোহালে’, ‘জারোয়াদের জঙ্গলে’, ‘আগুন পাখির খোঁজে’, ‘যত কান্ড মালদায়’, তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। এখন লেখালেখি ছাড়াও অবসর কাটান ছবি এঁকে, গান শুনে বা বই পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *