Spread the love

ধারাবাহিক গল্প: প্রমা , পর্ব-৫
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়

ঘরবাড়িগুলো সব পুরনো সেকেলে একটা বন্ধু-বান্ধব এলে ঘরে কোথায় বসবে ?
টুকু টুকুর বাবাকে প্রশ্ন করে ,
জানো সর্বাণী মৈত্রের বাড়ি কত বড়ো?
দুর্গাপুজো হয়, কত লোকজন,—
কি সুন্দর সব সাজানো গোছানো। আর আমার কিছু নেই,
ভাঙা গোলপাতার ছাউনি ওলা একটা বাইরের ঘর, সেখানেই বসার চৌকিপাতা, আর ভাঙা একটা চেয়ার।
টুকুর বাবা বলল তোর এ দুঃখ আমি আর রাখব না তোর জন্য একখানা ভালো ঘর বানিয়ে দেবো ।
একটা ঘর করতে সে লরি ভর্তি সিমেন্ট বালি লোহা মাল মেটেরিয়াল কিনে ফেললো।
গোল পাতার ঘর ভেঙে পাকা নতুন ঢালাই দেওয়া ঘর বারান্দা সিঁড়ির ঘরের মাথায় ঠাকুর ঘর,— সে এলাহি ব্যাপার !
ঘরটা শেষ করেই ইলেকট্রিক এনে, পাখাটা চালিয়েই টুকুর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল ।
হাই প্রেসার —
একদিন সকালে উঠে দেখি খুবই শরীর খারাপ,
সরলকে ডাক্তার ডাকতে বললাম,—
সরল ডাক্তার আনল ডাক্তার হাসপাতালে দিতে বললে,—
তারপর তোর দাদা মশাই আর হাসপাতাল থেকে ফিরে এলোনা।
মাত্র ৫০ বছর বয়সেই স্ট্রোক হয়ে আমাদের পর করে দিলে।।

তোর দাদা মশাই কে নিয়ে আমার আর পৃথক সংসার করার সুযোগ এ জীবনে হলো না।

শোকে পাথর হয়ে একভাবে দু-তিন দিন পড়ে রইলাম !
কি থেকে কি হয়ে গেল—
পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে বললে,
হ্যাঁ গো রাঙ্গাদি ,তোমার শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলবে,? মেয়েটার কথা কে ভাববে ?
ওঠো খাও নিজের দেখভাল করো।
নিজের মেয়ের কিছু ব্যবস্থা নাও। শক্ত হও ,এরকম সবারই হয়
তা বলে কেউ এমন বোকার মতন পড়ে থাকে—

শাশুড়ি ও এদিকে খাওয়া বন্ধ করেছে । পৌষের কনকনে ঠান্ডায় মেঘলা আকাশ চিরে, তখনই চিলের মতন আমার আকাশ জুড়ে ঘুরতে লাগল লালমনি ।
আমাকে নিঃস্ব করে দেওয়ার অভিসন্ধিতে মেতে উঠল—
রাতারাতি বাচস্পতি পাড়ার লোকজন ধরে একখানা উইল বানিয়ে ফেললো।
বলাই বাহুল্য লালমনির বাবার বাড়ি বাচস্পতি পাড়াতে ।( বাবার বাড়ির লোকেরা কখনো তার প্রতি কোন কর্তব্য পালন না করলেও এই অন্যায় কাজে তাকে সমর্থন জানালো।) এরপর টুকুর ঠাকুমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ার দিন আমাকে আর টুকুকে এই নতুন ঘরে পুরে শেকল তুলে দিল,

মিথ্যা সাক্ষী , মিথ্যাবাদী ডাক্তার ,পাড়ার কিছু (তোর দাদা মশায়ের শত্রু পক্ষের) লোকজন সকলের সহায়তায় পয়সার বিনিময় সব ব্যবস্থা পাকা করে , সেই উইলে শাশুড়িকে দিয়ে সেদিনই স্বাক্ষর করিয়ে নিলে,—
আমরা ঘর থেকে প্রাণপণ চেঁচামেচি করতে ,আদ্যাপীঠের মন্দিরের মিস্ত্রীরা এসে খুলে দিল। তারপর দিন থেকেই লালমনির গিন্নি পোনা চরমে উঠল।

প্রাণ থাকতে বুড়ি কিছুতেই ওদের উইলে সই করতে চাইছিলেন না, তবে সেদিনই বা সইয়ের বিষয়ে এত আগ্রহ কেন দেখা দিয়েছিল ,—
তা জানা গেল পরের দিনে
পরের দিন তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন —!
এটা ঘোষিত হল ।
কিন্তু মৃত্যু তার আগেই ,—
আগের দিনই হয়েছিল !!
তাই জন্যই ওই দিনে ওরা উইলে সই করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।
শুধু ছেলের মৃত্যুর কটা দিন পরে না মরে, যদি টুকুর ঠাকুমা কটা দিন আগে মারা যেতেন, তাহলে এ সমস্ত কোন ঘটনা ঘটতে পারত না।

সবই আমাদের নিয়তি
দুবেলা আমাদের মা মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলতে লাগলো

কারণ সব সম্পত্তি তোর দাদা মশাই মারা গেছে বলে টুকুর ঠাকুরমার হয়ে গেছে । আর টুকুর ঠাকুমা সবকিছুই will করে ওদের নামে দিয়ে দিয়েছে সুতরাং তোমাদের মা মেয়ের আর কিছু নেই, এবাড়িতে,
তোমরা এ বাড়ি ছেড়ে যত শীঘ্র সম্ভব চলে যাও।
এসব কথা শুনে আমার ছোট ভাই ও নিকটস্থ এক ভগ্নিপতি মিলে কোর্টে কেস ফাইল করে দিল
কেস চলতে লাগল ,
তাই ওদের সঙ্গে আমাদের কথা বলা বন্ধ হল। মা মেয়ে আলাদা তোলা উনুনে রান্না করে খেতে লাগলাম।
সুযোগ বুঝে যযমানদের মধ্যে একজন ইনকমপ্লিট বাড়িটার মাথায় টিন দিয়ে সমাপ্ত ঘোষণা করে ।
বাকি টিন সিমেন্ট বালি ইট দিয়ে নিজের একখানা ঘর বানিয়ে ফেললো।
তবু আমরা চুপচাপ রইলাম, অসময়ে লোক চটানো চলে না এর মাস খানেক পরে টুকুর বন্ধুর বাড়ি,টুকু গেলে টুকুকে টুকুর বন্ধুর মা বললে,
তোর আর বিয়ে হবে না।
আমি যে বললাম ,আমার জামাই এর বন্ধুর সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দিতে, তোর মার কানে সেটা ঢুকলো না।
মা মেয়ে একা কিভাবে মামলা মোকদ্দমা সম্পত্তি সামলাবি।

ভীতু আমি সবসময় ভয় পেয়ে শেষ হয়ে গেলাম। ওর বন্ধুর মার কথা মত হতদরিদ্র ঘরের একটা সামান্যে চাকুরে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম ।আমার ভাইয়ের এতে ঘোর আপত্তি থাকায় বিয়েতে উপস্থিত হলো না ।মানুষটা যাবার ৬ মাসের মাথায় যাহোক করে বিয়ে দিয়ে দিতে হলো, বিয়ে দিতে গিয়ে দোলপিঁড়ির মোড়ের জমি ও বিক্রি করতে হলো, নগদের টাকা মেটাতে— ক্ষতিই ক্ষতি হতে লাগলো !
মানুষ যখন একটা ভুল করে তখন মানুষের বুদ্ধি ভ্রম ঘটে,
সে পরপর ভুল করতেই থাকে! আমারও তাই হল,

দাদা মশায়ের শত্রু পক্ষরা ওই জমিটা ক্লাবের বলে দখল করে নিতে চেয়েছিল, সেই জমি কোর্টে কেস করে উদ্ধার করেছিল কত কষ্ট করে
পরিস্থিতির শিকার হয়ে তোর দাদা মশায়ের শখের অত কষ্টের জমিটা আমি হারালাম শত্রু পক্ষের আবারো জয়জয়কার।।

অপরপক্ষে জাল দলিল করার দায়ে যার জেলে যাওয়ার কথা তার সঙ্গে তোর বাবা মানে টুকুর বর হাত মিলিয়ে কেশটা তুলে নিলে। বললে তোমরা ভাই বোনে আধা আধা ভাগ করে নাও, বাড়ি অর্ধেক ওদের হয়ে গেল।
আবারো তোর দাদা মশায়ের শত্রুপক্ষের জয় হল ।আমার হাতের চারগাছা চুড়ি বেচে তোর দাদামশাই রান্নাঘর আর গোয়ালঘর বানিয়ে দিয়েছিল ,সে আর আমার ভোগ হলো না। সেগুলো ওদের দিকে পড়ে গেল। আমার বুকের যন্ত্রণা ধিক ধিক করে জ্বলে,
আমার আর কোন কিছুই খেতে ইচ্ছা হয় না ।
এভাবেই সব সৎ ব্যক্তির চিরকাল সর্বনাশ আর অসতের জয়জয়কার।।

প্রমা দিদাকে আবার ফিরে প্রশ্ন করল ,তা দলিলে কি লেখা ছিল?

সে অনেক কথা বাপরে বাপ !, উইলে লেখা ছিল নয়না দেবীর বর্তমানে দুই পুত্র মারা গেলে, সম্পত্তির ৫০ শতাংশ ছোট ছেলে অবিবাহিত থাকায় মার হয়ে গেছে.। অপরপক্ষে বিবাহিত পুত্রের অর্ধেক মায়ের আর অর্ধেক বউ ও মেয়ের ,—
অর্থাৎ বারোয়ানা চার আনা ভাগ।

যখন দেখলো উইল টি জাল খুব শীঘ্রই ধরা পড়ে যাবে এবং কিছুই পাবে না ,তখন ওরা বুদ্ধি খাটিয়ে তোর বাবাকে রাজি করালো যে আধা মানে চার আনা আছে, তার জায়গায় আট আনা পাচ্ছে, তোরা তো বেশি পাচ্ছিস, অর্থাৎ এতেই রাজি হয়ে যেতে না হলে বড় বিপদ হবে।
বিপদটা যে কার হত সেটা কেউই বুঝতে চাইলো না —
আমার পক্ষে দাঁড়ানোর কোন লোক ছিল না, তাই এই বিভাজন আমাকে মেনে নিতে হলো।।

এর সঙ্গে যোগ হলো টুকুর শ্বশুরবাড়ির সমস্যা,—

চলবে

One thought on “ধারাবাহিক গল্প: প্রমা , পর্ব-৫ দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়”
  1. ভালো লাগলো।গল্প উপন্যাস বিভাগ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *