Spread the love

পুরস্কার

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প)

বিধানচন্দ্র হালদার

–জেলা বইমেলার পুরস্কারটা, আমাকে কিন্তু এবার দিতেই হবে।
–আপনার কোনো লেখা বই-টই আছে?
–না।
–তবে আপনাকে কী ভাবে পুরস্কার দেবো?
–আরে, আগে পুরস্কারটা দিন ,পরে আমি সময় করে কবিতা লিখে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে নেবো।

সুপ্রকাশ বাবু চমকে উঠলেন ,বলেন কি রতন বাবু? একটিও কবিতা নেই রতনবাবুর, তাও জেলা বইমেলার পুরস্কারটার দাবিদার? সে বছর রতন বাবু কেন, কোনো বাবুকে জেলা বইমেলার পুরস্কার দেওয়া হয়নি।

রতনবাবু ভেঙে পড়েননি। তিনি এখন খাতা কলম নিয়ে দুই একটা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। একটি কবিতা ফেসবুকে দিয়েছেন । ফোন নম্বর সমেত।

এমন সময় কলকাতা থেকে চন্দ্রযান পত্রিকার সম্পাদকের ফোন–
–হ্যালো, কে রতন বাবু?
–হ্যাঁ, বলুন , আমি রতন বাবু বলছি।
— আপনার লেখাটা বেশ ভালোই?
–তাই নাকি।
–হ্যাঁ ,আপনাকে আমরা ঠিক করেছি ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার দেব?
–এ তো আমার পরম সৌভাগ্য, আমাকে কি করতে হবে।
–কিছু না, কেবলমাত্র পাঁচশত টাকা দেবেন?
–বেশ রাজি।

রতন বাবু হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ছন্দ কাকে বলে বা ছন্দ কত প্রকার তা না জানতে পারে। কিন্তু ছন্দের যাদুকর পুরস্কার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এমন কি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতাও সে পড়েননি।

এর সাত দিন পর “সূর্য যান” পত্রিকা থেকে ফোন–
–হ্যালো, কে রতন বাবু?
–হ্যাঁ ,রতন বাবু বলছি।
–whatsapp গ্রুপে আপনার কবিতা দেখলাম, আপনি নিয়মিত কবিতা লেখেন?
–খুব বেশি নয়, কমও নয়।
–তবু কটা কবিতা লিখেছেন এই ষাট বছর বয়সে?
–খানপাঁচেক তো হবেই।
–আমরা ঠিক করেছি ,আপনাকে মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার দেওয়া হবে?
–সে তো পরম সৌভাগ্যের ।আমাকে কি করতে হবে।
–যা বাজারদর ট্রফি ও সার্টিফিকেট মিলে এই ১০০০ টাকা দিলেই হবে।
–বেশ রাজি।

রতন বাবু হাতে সূর্য পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মধুসূদন সম্পর্কে তার কোনো ধারনা নেই। কিভাবে মধুসূদ সনেট রচনা করেছিলেন সে সম্পর্কেও ধারণা নেই। পুরস্কার পেলে কার না ভালো লাগে। রতন বাবুর ভালো লেগেছিল।

এর ১৪ দিন পর মর্নিং স্টার পত্রিকার সম্পাদক ফোন করলেন–
–হ্যালো, রতন বাবু?
–হ্যাঁ, আমি রতন বাবু।
–আপনার কবিতাখানি খুবই ভালো?
–কোথায় দেখেছেন।
–এইতো যেটি আজ হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস দিয়েছেন?
–ওও..
–বেশ ভালো লিখেছেন, আপনাকে জীবনানন্দ পুরস্কার দেব?
–আমাকে কি করতে হবে।
— আরে কিছুই না, আপনাকে যে ট্রফি, সার্টিফিকেট ও খাওয়া দেব সবমিলিয়ে হাজার দুই দিলেই হবে?
–বেশ রাজি।

রতন বাবু রূপসী বাংলা বা বনলতা কাব্যগ্রন্থের নামই কখনো শোনেননি কিন্তু পুরস্কার পেলে কার না ভালো লাগে, রতন বাবুরও খুবই ভালো লেগেছিল।

এর একমাস পর নাইট ফাইটার পত্রিকার সম্পাদক ফোন করলেন–
–হ্যালো, কে রতন বাবু?
–হ্যাঁ, রতন বাবু বলছি।
–আপনার কবিতাখানি খুব ভালো হয়েছে?
– কোথায় দেখেছেন।
–ফেসবুক পেজে
-ওও. ..
–আপনি ভালোই লিখেছেন ,আপনাকে দক্ষিণের রোদ্দুর পুরস্কার দেয়া হবে?
— এ তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমাকে কি করতে হবে।
–কিছুই নয়, কেবলমাত্র পুরীর হোটেল ভাড়া বা বকখালীর হোটেল ভাড়া, আর একটু রঙিন জল টলের জন্য হাজার পাঁচেক টাকা দিলেই হবে?
–বেশ, আমি রাজি।

সুপ্রকাশ বাবু ঘুরতে ঘুরতে একদিন রতন বাবুর বাড়িতে গেলেন, এবং বললেন–
–ফেসবুকে তো আপনার প্রচুর পুরস্কার লক্ষ্য করলাম।
–হ্যাঁ, ঠিক দেখেছেন।
–কটা পুরস্কার পেলেন?
–আমার পাশের রুমে আসুন–

পাশের রুমে গিয়ে সুপ্রকাশ বাবু পুরস্কারের সংখ্যা গুনে দেখেন ,প্রায় সেঞ্চুরি। ঘরের মধ্যে ট্রফি, ব্যাচ, সার্টিফিকেটের ছয়লাপ। সুপ্রকাশ বাবু যত দেখছেন তত অবাক হচ্ছেন। বিস্মিত চোখে সুপ্রকাশ বাবু বললেন–
–রতন বাবু, আপনার কটা কাব্যগ্রন্থ বেরোলো?
–এখনো একটাও প্রকাশ করতে পারিনি।
–দেখি আপনার কবিতার ডায়েরী?

কবিতার ডায়েরীতে খান দশেক কবিতা, তা আবার এত হিজিবিজি করে লেখা, সুপ্রকাশ বাবু পড়তে পারেননি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো কবি বাকি নেই যে ,তার নামে পুরস্কার পাননি। সব কবির নামাঙ্কিত পুরস্কার রতন বাবু পেয়েছেন। তার লেখার থেকে পুরস্কারের সংখ্যা কয়েক হাজার গুণ বেশি।

বালির তৈরি শিখর দেশ ।অরুণ ছাড়া অরুণোদয়, চন্দ্র ছাড়া জ্যোৎস্নার আলো, বৃক্ষ ছাড়া সবুজ বন শীর্ষ, কুঁড়ি ছাড়া ফুল–এই সবকিছুর অপূর্ব শোভা জ্বলজ্বল করছে রতনবাবুর রুমে! বিধাতার তৈরি পত্রিকা গোষ্ঠীকে শত কোটি প্রণাম। “রতনে রতন চেনে, …..তারা রতনকে একদম ঠিকঠাক চিনেছেন ! “।

রতন বাবু শেষ বয়সে এসে, নিজের হাজার হাজার পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে নিজেই লজ্জিত হলেন। চাঁদ আজ বড্ড বেশি ম্লান। ক্ষয়িত সূর্য তার কাছে আজ বৃথা মনে হচ্ছে।

রতন বাবু হঠাৎ সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন– পাখিগুলি শৃঙ্খলা মেনে আকাশে উড়ে চলেছে…

সময়ের দর্পণ কবি
বিধানচন্দ্র হালদার
শান্তিনিকেতন। কবিতা কুঞ্জ।
17.12.2023

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *