Spread the love

গল্প

খাসিয়া পাহাড়ের ঢালে।
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

(লেখক পপরিচিতি :

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।)

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>

CAA অর্থাৎ নাগরিকতা সংশোধন আইন নিয়ে গোটা উত্তর পূর্ব ভারত উত্তপ্ত। আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর সবকটি রাজ্যের মানুষ ফুঁসছেন। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসাবে ঘন ঘন সীমান্ত সংঘর্ষ হচ্ছে। কখনও আসাম-মেঘালয় বর্ডারে, কখনও মেঘালয়-মিজোরাম বর্ডারে কখনও মণিপুর-মিজোরাম বর্ডারে সংঘর্ষ লেগেই আছে নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে। তার উপর রাজধানী শহরগুলিতে অর্থাৎ গৌহাটি, শিলং, ইম্ফল, আইজল, সর্বত্র জাতি দাঙ্গা বেধে গেছে। প্রতিদিন পাহাড়ের চূড়াগুলি উত্তর পূর্ব ভারতে লালে লাল হচ্ছে নিরিহ মানুষের খুনে। পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে নিরীহ মানুষের এবং নিউস কভার করতে মধ্য সত্তরের প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায় এসেছেন শিলং-এ। এখানে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে দুদিন ধরে কথাবার্তা বলে এসেছেন পূর্ব খাসিয়া পাহাড়ে। এখানকার ছোট ছোট পার্বত্য উপজাতি গ্রামগুলিতে যথা মালাই, মফলাং, মাসিংরাম, সোহিওং, মপাট, মাইলিয়েম ইত্যাদি ছোট ছোট পার্বত্য উপজাতি গ্রামগুলিতে। গ্রামগুলিতে বিদেশী হঠাও আন্দোলনের নামে রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। মাফলাং ব্লকের অধীন এই গ্রামগুলিতে এগারোজন মানুষ খুন হয়েছেন। অধ্যাপক নীহার রায় এই বেদনাদায়ক ঘটনার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে নেমে পড়েছেন।


সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ ফুট উঁচুতে বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ প্রমুখ এলাকা। দেশভাগের করুণ ফলশ্রুতিতে বহু মানুষ সাবেক পূর্ব পাকিস্থান থেকে এই সব এলাকা ছেড়ে খাসিয়া এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উচুঁতে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ঢালে বসতি করা শুরু করেছে। তারপর, ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খান সেনাদের অত্যাচারে শরণার্থী হয়ে এখানে এসে থিতু হয়েছে বহু মানুষ। তারা প্রায় সকলেই বাঙালী। এর মধ্যে হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল।
সাংবাদিকতার আগে নীহার রঞ্জন বাবু দীর্ঘদিন সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছেন কোলকাতার একটি নাম করা কলেজে। কাজেই তথ্য সংগ্রহের সব কৌশলই তাঁর জানা। Research Methodology তিনি Post graduate class-এ পড়াতেন। বিভিন্ন বইপত্র, সরকারী-বেসরকারী সূত্র থেকে প্রচুর Data পেয়েছন। তার উপর, Observation and Interviewing -এর মাধ্যমে বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার তাঁর হাতে এসেছে এই এলাকার আদি বাসিন্দা খাসিয়া জনজাতি সম্পর্কে। তিনি জেনেছেন যে ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরা পাহাড় থেকে খাসিয়া উপজাতির মানুষরা এসে এই পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। প্রথম দিকে এরা ছিল যাযাবর। তারপর, ধীরে ধীরে ছোট ছোট গ্রাম বা পুঞ্জি গঠন করে এরা বসবাস শুরু করে। এরা খুবই সহজ ও সরল। কৃষি কাজই এদের প্রধান উপ জীবিকা। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালীদের সাথে এরা সুন্দরভাবে মিলেমিশে থাকে।


তাহলে কেন এই শান্তশিষ্ঠ প্রকৃতির সবুজ কার্পেটে ঢাকা পাহাড়ের ঢালে এত রক্তপাত, এত বিদেশী বিতাড়নের হানাহানি? এই উত্তর খুঁজতে নীহার বাবু ও তাঁর সঙ্গীরা একেবারে চিরুনী তল্লাশী করছেন। খাসি পুঞ্জি ও বাঙালী পট্টি, সব তন্ন তন্ন করে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় রেখেছন। এই প্রক্রিয়া চালানোর সময় মাফলাং গ্রামে একটা ছোট্ট মিশনারী স্কুল তাঁদের নজরে এলো। উৎসাহ নিয়ে নীহার বাবু সেই প্রতিষ্ঠানটিতে গেলেন শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে। জাতি দাঙ্গা তথা NRC আন্দোলনের কোন সূত্র যদি পাওয়া যায় এই ভেবে।
স্কুলে গিয়ে দারোয়ানের কাছে জানলেন যে হেড স্যারের সাথে গ্রান্ট আদায়ের জন্য স্কুলের সমস্ত টিচিং ও ননটিচিং স্টাফ ৬৫ কিলোমিটার দূরে, মেঘালয়ের রাজধানী শহর, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত শিলং শহরের Education Directorate -এ গেছেন:  শুধু হেডক্লার্ক বাবু অফিসে আছেন। খানিকটা হতাশ হলেন নীহার বাবু। তবু, দেখা যাক, একজন হলেও যদি তাঁর থেকে কোনো ক্লু পাওয়া যায়, মনে মনে এই ভেবে তিনি দরোয়ানকে Follow করে অফিসের দিকে আগালেন। দরজার কাছে এসে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই হেড ক্লার্কের দিকে নমস্কার দিয়ে একটা ভিজিটিং কার্ড তাঁর হাতে দিলেন।


–sit down please, বলে হেডক্লার্ক ভদ্রলোক কার্ডটিতে চোখ বোলাতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যে মেঘলা আকাশে বিজলির ঝিলিকের মতো আবেগে চীৎকার করে উঠে আদ্যোপান্ত সাহেবী পোশাকে মোড়া মানুষটি ঝরঝরে বাংলায় বললেন–স্যার আপনি?
একরকম লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে ওঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে ভদ্রলোক বললেন–আমি বিষ্ণু, আপনার ছাত্র, বিষ্ণুপদ বিশ্বাস স্যার। সাউথ সিটিতে আপনার ছাত্র ছিলাম।
–বিষ্ণু! মানে Nineteen Eighty Six–এর ব্যাচ?
–হ্যাঁ স্যার।
–মানে সেবারের CU তে অনার্সে First Class First হওয়া Glorious boy?
–দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান মুখে বিষ্ণু বললে
–ওসব কথা আজ থাক স্যার। এখন বলুন, আপনি কেমন আছেন স্যার? কাকীমা ভাইবোনরাও?
–কেন? কেন? থাকবে কেন? সেটাই আগে বলো। কাকীমা-ভাইবোনরা সবাই ভালো আছে।
–স্যার, আমি মোটেও ভালো নেই। ভালো থাকলে কি সুদূর পশ্চিমবাংলার শ্যামলী সমতল ছেড়ে এই দুর্গম পাহাড়ের নীলিমার বুকে আশ্রয় নিতাম?
–কেন বাবা? অনার্সে তোমার অত ভালো রেজাল্ট। এম. এতেও . . .
–হ্যাঁ স্যার, এম. এ. তেও আমি CUতে First Class পেয়েছিলাম।
একটু থেমে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষ্ণু বলল–
কিন্তু, লাভ কি হোল স্যার এমন Brilliant result করেও? বামফ্রন্ট আমলে আমরা যারা কোন দল করি না, তারা হলাম দলবাজির শিকার, আর তৃণমূলের আমলে তো মা মাটি মানুষের সরকারের নামে মাফিয়া মাতাল আর অমানুষদের তুলনাহীন ব্যাভিচার ও দুর্নীতি স্বজন পোষণ ও প্রতারণার শিকার।
–তার মানে বিষ্ণু তুমি . . .
–হ্যাঁ স্যার, তার মানে আমি কোন চাকরিই পাইনি। অথচ, তখন আমার মুখ চেয়ে বসে আমার বৃদ্ধ বাবা মা, দুটি Teen aged ছোট বোন। তাদের মুখে দুবেলা দুটো আহার যোগাতে হবে। কাজেই আমার বসে থাকার ফুসরৎ ছিল না। কখনও আসামের চা-বাগিচায়, কখনও কেরালার নারকেল বাগানে, কখনও দেরাদুনের আঙুর ক্ষেতে, কখনও অন্ধ্রের মেছো ঘেরিতে, Labour contractor-এর হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে সংসারটাকে কোনোমতে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছি মাত্র।


বিষ্ণুর মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে বেদনায় ডঃ রায় নির্বাক হয়ে গেলেন। একটু ধমক সামলিয়ে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–তা এখানে কীভাবে এলে বাবা?
–স্যার! সেও এক বেদনার ইতিহাস! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষ্ণু বলল–
সুচিকিৎসার অভাবে আমার বাবা মা একজন ক্যানসারে, একজন হার্টের অসুখে অকালে মারা যান। বাড়ীটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। বোন দুটি ছিল আমার খুবই মেধাবিনী ও সুন্দরী। অতিকষ্টে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো কাজের তাগিদে বাইরে বাইরে। কাজেই ওরা দুই বড়লোকের ছেলের প্রেমের জালে বাঁধা পড়ে। আমিও বাধা দিইনি।

কারণ, ভেবেছিলাম, অল্পবয়সী অভিভাবকহীনা বোনদুটি আমার সুরক্ষা পাবে। ওদের বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুর বাড়ীর লোকরা দু’জনেরই খুব ভালো ছিল। ছেলে দুটিও আমার বোনদের খুব ভালোও বাসতো। কিন্তু, অঢেল পয়সা। দু’জনেই প্রচণ্ড Drink করতো। এই পাপ নেশা থেকে আমার বোনরা ওদেরকে ছাড়াতে পারেনি। দেড় বছরের মধ্যেই সব শেষ। একটি করে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েই ওরা দু’জনেই লিভার নষ্ট হয়ে মারা গেলো। খাবার কষ্ট ওদের নেই স্যার। কিন্তু, অকালবিধবা বোনদুটির মুখের দিকে তাকানো যায় না। তাছাড়া দু’জনেরই মাথার উপরে শ্বশুর বাড়ীতে কেউ নেই। ফলে বুঝতেই পারছেন স্যার! বোন দুটি আমার কি মানসিক ও অভিভাবকহীনতার কষ্টে আছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যার বললেন
–সত্যিই খুবই প্যাথেটিক। একটু থেমে উনি জিজ্ঞেস করলেন–তা বাবা, তোমার ঘর সংসার?
এতক্ষণের বিবর্ণ মুখখানা লজ্জারাঙা হয়ে উঠলো। বিষ্ণুর মুখের ভাষা বুঝতে পেরে উনি বললেন–বুঝেছি, বুঝেছি, আমার বৌমা নিশ্চয়ই খুবই মিষ্টি মেয়ে? তা বেশ, বলো বলো, আমার মিষ্টি বৌমার সম্পর্কে বলো।
–স্যার বাবা মায়ের এক রকম অর্থাভাবে অকাল মৃত্যু, তারপর ছোট বোনদুটির অমন ভাগ্য বিপর্যয়, সব মিলিয়ে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। নিদারুণ মনোভঙ্গে ঠিক করেছিলাম যে সারাটা জীবন ব্যাচিলারই থেকে যাবো। কিন্তু . . .।
–কিন্তু কি বিষ্ণু?
মোবাইলটা অন করে সে সলজ্যভাবে উত্তর দিল–এই আপনার বৌমা, মারিয়ানা যোসেফ, ওর সঙ্গে আলাপ হতে সব অঙ্ক ভেস্তে গেল স্যার।
–কই দেখি, দেখি। এ যে সাক্ষাৎ মা ভগবতী। এ যে goddess Angelica কি সুন্দর! কি অপূর্ব, কি মিষ্টি দেবী প্রতিমা। কি করে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে পেলে আমার এই মিষ্টি মামনিটাকে? 
–স্যার! দেরাদুনে আঙুর ক্ষেতে লেবার কনট্রাকটার হিসাবে কাজ করতে করতে ওখানকার স্টোর কিপার বেঞ্জামিন যোসেফের সঙ্গে পরিচয়। স্বল্প বেতনের কর্মচারী। অফিস কোয়াটারেই থাকতেন family নিয়ে। খুবই উদার খৃষ্টান পরিবার। মারিযা ও জন, আর নিজেরা দুজন এই চারজনের সংসার। দুই ভাই বোন ছিল পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী। কিন্তু, দেরাদুনে cost of education খুব High। কাজেই বাচ্চাদের টিউশান দেবার ক্ষমতা ওনার ছিল না। আমি তখনও স্যার মারিয়া বা জনকে দেখিনি। একদিন বিকালে কথা প্রসঙ্গে উনি ওনার অসহয়তার কথা বললেন। শুনে খুব কষ্ট হোল। আমি বোললাম–
If you kindly permit I may try. ভদ্রলোক যেন হাতে চাঁদ পেয়েগেলেন। শুরু হোল দুই ভাই বোনকে পড়ানো। আস্তে আস্তে আমার মরুময় জীবনের সব ওঁরা জানলেন। গোটা পরিবার যেন স্নেহ মায়া মমতার জালে আমায় বেঁধে ফেললেন। ওঁদের হৃদয়ে পরশে আমার জীবন সাহারা মরুদ্যান হয়ে উঠলো। আপনাকে বোলতে কোনো দ্বিধা নেই স্যার। আমার থেকে বয়সে সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট আপনার বৌমা। ওর বাইরেটা যত সুন্দর, ভেতরটা ততোধিক। তার উপর ভীষণ সরল ও মেধাবিনী। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ও আমায় আপন করে ফেলল। নিজেকে হারিয়ে ফেললাম মারিয়ার মাঝখানে। আমরা বিয়ে করে ফেললাম।
–খুব সুন্দর। খুব সুন্দর।
–না স্যার, সবটা খুব

সুন্দরভাবে মেটেনি।
–কেন বিষ্ণু?
–মারিয়াদের পরিবার যে খুব liberal। পরিবার ছিল, তা আমি আগেই বলেছি।
–আমরা দু’জনেই চেয়েছিলাম যে ওর বাবা মা দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়েটা দিন। কিন্তু সমস্যা এল দেরাদুনের প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয় সম্প্রদায় থেকে।


–কি সমস্যা বাবা?
–আমাদের ধারণা স্যার যে ক্যাথলিকরাই শুধু রক্ষণশীল। প্রোটেস্টান্টরা খুব liberal। কিন্তু না স্যার। ধর্মীয় প্রশ্নে উভয়েই সমান রক্ষণশীল। উভয় সম্প্রদায়ই ফতোয়া দিল যে আমায় আগে খৃষ্টান হতে হবে, তারপর মারিয়ায় সাথে আমার বিয়ে হবে। নাহলে বেঞ্জামিন পরিবারকে excommunicate করা হবে। এই ঘটনায় মারিয়ার আশ্চর্য রকমের ভাবান্তর হোল।
–কি রকম?
–আপনি আমার স্যার, আমার গুরু। নিঃসংকোচেতে বলি, স্বজন বন্ধু হারা হয়ে দীর্ঘদিন একাকী থাকার পর মারীয়ার ভালোবাসা পেয়ে নতুন কোরে বাঁচার স্বাদ পেয়েছিলাম। এটাকে আমি আর হারাতে চাইনি। তাই মারিয়াকে পেতে, তার জন্য আমি সব কিছু ত্যাগ করতে রাজী ছিলাম। এমনকী খৃষ্টানও হতে রাজী ছিলাম। কিন্তু স্যার আশ্চর্য। আমার খৃষ্টান হবার কথা শুনে শান্তশিষ্ট অষ্টাদশী তরুণীটি সাপিনীর মতো ফুঁসলে উঠলো। সে জেদ করলো, কিছুতেই আমায় ধর্মান্তরিত হতে দেবে না–হিন্দুকেই সে বিয়ে করবে। আমি ওকে ওর বাবা মায়ের অসহয়তার কথা বোঝালাম। চুপ করে থাকলো–শুধু চোখের জলে চিবুক ভাসালো। ভাবলাম, হয়তো কিছুটা ও নরম হয়েছে। কিন্তু না স্যার। আমায় তাক লাগিয়ে দু’দিন বাদে গভীর রাতে মারিয়া তার বাবা মাকে নিয়ে চুপি চুপি আমার কোয়াটারের দরজায় এসে কড়া নাড়লো। দরজা খুললাম এক মিনিটের মধ্যে মারীয়ার হাত দুটো আমার দুহাতে মিলিয়ে দিয়ে তার উপর একটা লাল কাপড়ের পুঁটুলি রেখে ওর বাবা মা বললেন, “May Jesus save you, Go away at once”
–নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে মানুষ দুটো মিলিয়ে গেলেন। মারীয়ার হাত ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কয়েক ঘন্টার মধ্যে যেন সংসার-অনভিজ্ঞ অষ্টাদশী তরুণীটি আমার থেকেও পাকা গিন্নি হয়ে গেল।
ওর বাবা মা যে পুঁটুলিটা দিয়েছিলেন, তাতে ছিল ভরি দশেক সোনা ও লাখ তিনেক টাকা। ছিনতাই এড়াতে দুজনে দুজনের অন্তর্বাসের মধ্যে করে সেগুলো সযত্নে নিয়ে এলাম। পরদিন ভোরবেলায় মারিয়ার ইচ্ছাতে হরিদ্বারের হরকী গিয়ারী মন্দিরে পূজো দিয়ে ওকে সিঁদুর পরিয়ে দিলাম। এরপর মারিয়াকে সারপ্রাইজ দিয়ে কংখালের এক গীর্জায় ওকে সাথে নিয়ে একটা রিং পরিয়ে দিলাম।
–দারুণ। দারুণ। এই না হলে আমার ছাত্র।
–স্যার, আমরা দু’জন দু’জনকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতাম এবং আজও ভালোবাসি যে ধর্ম আমাদের দু’জনের মধ্যে কোন বেড়াজাল তৈরি করতে পারেনি। মারিয়ার বাবা মাও সেটা বুঝতেন। তাই, আমাদের দু’জনকে বাঁচাতে আবার মারিয়ার ভাই জন সহ নিজেরা তিনজনে বাঁচতে, গোপনে আমাদের দু’জনে নিরাপদে পালাতে সাহায্য করেছিলেন কিছু দিনের রসদের ব্যবস্থা করে। রটিয়ে দিয়েছিলেন আমরা দু’জনে পালিয়ে গেছি।
একটু থেমে বিষ্ণু বললে in fact sir! আমি ও মেরিয়া দু’জনেই খুবই Spiritualistic: তবে কিষ্ট ও খৃষ্টকে নিয়ে কোন রকমের বিরোধের আমরা বিরোধী। আমরা দুজনেই কিষ্টো ও খীষ্টোকে পূজো করি।
জন্মাষ্টমী, বড়দিন, সব করি।
–interesting!
–মারিয়া বড়দিনে কেক বানায়। কি করে তালের বড়া, ঝালের নাড়ু করতে হয় তা আমি মারিয়াকে শিখিয়ে দিয়েছি। জন্মাষ্টমীতে ও ওগুলো বানায়।
–এতো দেখছি রূপকথা শোনাচ্ছো তুমি বিষ্ণু।
–না স্যার। আপনি গুরুজন। আপনাকে সব সত্যি কথাই বলছি। একটু থেমে বিষ্ণু বোললো– আপনার একটা দাদুভাই ও দিদুভাই আছে স্যার। এই দেখুন, মোবাইলে ওদের ছবি। ওরা Twin baby
বিষ্ণু মোবাইল ক্লিক করে ওদের ছবি দুটো দেখালো।
–বাঃ! এতো নন্দনকাননের দুটি অপূর্ব সুন্দর ফুল।
–তা জানি না। তবে ওরা Twin baby।
–তাই বলো! এত সুন্দর দুটি শিশুর একই রকম বয়স দেখাচ্ছে সেজন্য। তা আমার দিদুভাই দাদুভাইদের নাম কি রেখেছো বিষ্ণু?
–ডেলিভারীর আগেই মারিয়ার কথা ছিল ছেলে হলে তার নাম ও রাখবে, আর মেয়ে হলে তার নাম আমি রাখবো। হাসপাতালে ওরা হয়েছে বটে কিন্তু normal delivery স্যার। দু’জনের জন্মের ব্যবধান মাত্র কয়েক মিনিট। আগে হয়েছে ছেলে। তার একটু বাদেই মেয়ে। একসঙ্গে ঈশ্বরের দেওয়া জোড়া ফুল পেয়ে, সমস্ত যন্ত্রণা কাতরতা ভুলে লেবার টেবিলেই আনন্দে মারিয়া বলে ওঠে
“Bidhan, Bidhan, our son, আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়েই ও ছেলের নাম রাখে। আর আমি মারিয়ার নামের প্রথম অক্ষর দিয়েই মেয়ের নাম রাখি মেরী।
–ওঃ! কি মিষ্টি! কি সুন্দর! তা বিষ্ণু, এখানে তুমি এলে কীভাবে?
–স্যার! দু’জনে পালিয়ে এসে বিয়ে করে বছর দেড়েক খুব কষ্টে ছিলাম। মারিয়া আমায় কষ্ট করতে দিতে রাজী ছিল না। ওর বক্তব্য ছিল যে ওর বাবা মা যে টাকা ও গহনা দিয়েছেন, তা বুঝে বুঝে খরচ করে সংসার চালাই। ততক্ষণে, দু’জনের একটা কাজ জুটে যাবে। কিন্তু আমি ওর পড়াশুনাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর ছিলাম। তাই সঞ্চিত টাকাটা খরচ না করে নিজে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম শুরু করি-হরিদ্বারের একটি লজে। তারপর গোপনে মারীয়ার বাবা ওঁর এক বন্ধুর মারফৎ যোগাযোগ করে আমায় এই মিশনারী স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। হরিদ্বার ছেড়ে আমরা এখানে চলে আসি। মারিয়াকে এখানকার North Eastern Hill university তে এম. এ তে ভর্তি করিয়ে দিই।


বিষ্ণু বলে চলল –স্যার, দেরাদুনের চেয়ে শিলঙে Cost of Education আরও High স্বভাবতঃই, মারিয়াকে পড়াতে হিমসিম খেতে হোত। মারিয়া নিজে টিউশানী করে খানিকটা পড়ার খরচ যোগাড়ের কথা বলে। কিন্তু, আমি চাইতাম ও আর্থিক চিন্তা না করে Whole heartedly M.A. টা করে ভালো রেজাল্ট করুক। সেকারণ, ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, স্কুলের শেষে একটা ট্রাভেলিং এজেন্সিতে পার্ট টাইম কাজ করতাম। এইভাবে খুব কষ্ট করে দু-জনার সংসার ও মারিয়ার পড়াশুনা চালাতাম। তারপর, এম. এ. সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় মারিয়া মা হতে চলল। ওর জন্য তখন বিশেষ কেয়ার নিতে হোল। যাতে ওর কোন শারীরিক ধখল না হয় তার জন্য মারিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও শাশুড়ী মাকে এনে রাখলাম। ফলে খরচ আরও বাড়লো। তারপর ঘর আলো করে আপনার দাদুভাই দিদুভাইরা মারিয়ার কোলে এলো। খুশীতে দু’জনে ডগমগিয়ে উঠলাম। কিন্তু একা একা ভাবতে লাগলাম যে কি করে সময় বাঁচিয়ে সৎ ভাবে আরও দুটো পয়সা রোজগার করা যায়।
জানেন স্যার। মারিয়া অসম্ভব সরল; আর আমার উপর ওর অগাধ বিশ্বাস। মনে মনে ওর কাছে ও ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ওকে মিথ্যা বললাম যে স্কুলের কাজের বহর বেড়েছে। অল্প কিছু বেতন ওরা বাড়াবে। পনের ঘন্টা কাজ। সরল মনে মারিয়া সব বিশ্বাস করে নিলো। সদ্য প্রসবা মায়ের অসুস্থ শরীর নিয়ে ও ভোরে উঠে আমার খাবার বানিয়ে দিত। ওর মা বৃদ্ধা মা যত সম্ভব চেষ্টা করতেন। তবুও ওর পোষাতো না। ও নিজ হাতে আমার খাবার গুছিয়ে দিত। ফলে আমার ও ওর দু’জনেরই শরীর ভাঙ্গতে লাগলো। কিন্তু মনের জোরে আর ভালোবাসার শক্তিতে দু’জনে স্যার সব অতিক্রম করেছি।
এই অবস্থার মধ্যে এম. এ পরীক্ষা দিয়ে ও brilliant রেজাল্ট করে। First Class Second হয়। ব্যাস আমার দুঃখের দিন শেষ হোল। রেজাল্ট আউটের পরের দিনই ওর HOD-এর সুপারিশে ও শিলং কলিজিয়েট হাই স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল। জয়েন করে ফিরে এসেই ও আমায় তিনটি শর্ত দিলো।
–আচ্ছা?
–এক, আজই আমায় ঐ ১৫ ঘন্টার স্কুল চাকরি ছাড়তে হবে: দুই, বাচ্চা দুটোকে সামলাতে মায়ের সাহায্যের জন্য একজন দায়িত্বশীল গভরনেস রাখতে হবে। তিন, মাইনের সব টাকা ও আমার হাতে দেবে। আমাকেই সব খরচ করতে হবে। এমনকী, আমি হাতে করে যা দেব, সেটাই ও হাত খরচ হিসেবে নেবে।
বিষ্ণুর পিঠ চাপড়ে স্যার বললেন–অনেক অনেক ভাগ্য করে বাবা তুমি এমন জীবন সঙ্গিনী পেয়েছো। বাঃ বাঃ সাবাস, সাবাস।
–জীবন সঙ্গিনী নয় স্যার, হেসে বিষ্ণু বললো, একেবারে মিটমিটে রায়বাঘিনী স্যার।
–কেন কেন বাবা?
–আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই স্যার; প্রথমে সহজ সরল ছাত্রী, তারপর নিবিড় প্রণয়িনী, তারপর বিশ্বস্ত ঘরনী, হিসাবে মারিয়াকে পেয়েছি; কিন্তু পরিচয়ের পর থেকে কোন দিন ও ওর রায়বাঘিনী মূর্তি দেখিনি। সেদিন রাতেই প্রথম দেখলাম।
–কি রকম?
— ও যখন পরদিনই স্কুলের চাকরিটা ছাড়ার কথা বললো, তখন ঠিক করে ফেললাম, এবার সত্যি কথাটা মারিয়াকে বলব। বলেও ফেললাম। মিথ্যা বলার জন্য ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে, ওর হাত দুটো ধরে। প্রথমে শুনেই তো কেঁদে আকূল হোল। সে কান্না আর থামানো যায় না। তারপর অনেক বাদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আমার বললো, “you are cruel, you are cruel” আমার সাথে সপ্তাহখানেক আলাপ বন্ধ রাখলো। রাগ করে না খেয়ে দুর্বল শরীরে স্কুল যেতে লাগলো। আমি একবার ভাবলাম, চাকরিটা কি সত্যি ছেড়ে দেবো? শেষ পর্যন্ত ওর বাবা এসে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর রাগ ও অভিমান দূর করেন। আমার বিরুদ্ধে ওর অভিযোগ ছিল, এত পরিশ্রমের ফলে যদি আমার কিছু হোত? তাহলে ওর ধারণা ছিল, ওর এম. এ পড়ানোর জন্যই বুঝি আমার এত কষ্ট করা। তাই কেন আমি এত ব্যয় সাপেক্ষ পড়ানোর ঝুঁকি নিলাম? এম এ না পড়েও তো কিছু না কিছু একটা কাজ ও পেতো, ইত্যাদি।


–বিষ্ণু, আমি তোমার গোটা অতীতটা জানি। এতো Brilliant result করেও তুমি কোন চাকরি না পেয়ে, বাবা মা বোনদের বাঁচাতে যে কঠোর সংগ্রাম করে ওদেরকে সাধ্যের অতিরিক্ত সেবাযত্ন করেছো, সেই আশীর্বাদেই তুমি আজকের এই সুন্দর মধুর জীবনটা উপহার পেয়েছো। রক্তমাংসের মারিয়া মাকে চোখে দেখিনি বটে, কিন্তু এটা বুঝেছি, এই দেবীকা, এই রক্তমাংসের প্রতিমা তোমার মরুময় জীবনকে মরুদ্যানে ভরিয়ে দিয়েছে। তোমাদের দাম্পত্য জীবন, আরও সুখের হোক, আশীর্বাদ করি, সন্তানগর্বে তোমরা গর্বিত পিতামাতা হও।
হাত ঘড়ির দিকে চোখ দিয়ে স্যার বোললেন–অনেকক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে করতে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম। এবার তোমার কাছে আমার একটা জিজ্ঞাসা বাবা–
–বলুন স্যার।
–কেন তোমাদের এখানে এত জাতিদাঙ্গা?
–কোন রাখঢাক না করেই আপনাকে বলছি স্যার–এক নম্বর হোল বঞ্চনা,

দু’নম্বর হোল ষড়যন্ত্র।
–একটু স্পষ্ট করে বলো বাবা।
–স্যার, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা এই খাসিয়া জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চল। বনজ, খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার এখানকার পাহাড়গুলি। অথচ, ক্ষুধা, দারিদ্র বেকারী ও অনুন্নয়ন এখানকার মানুষদের নিত্য সঙ্গী। এখানকার আদিবাসিন্দা খাসিয়ারা অত্যন্ত সহজ ও সরল। দেশভাগের পরিণামে পুর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙালী হিন্দু ও মুসলিমরা এদেরকে নির্মমভাবে শোষণ করে। তার উপর মুসলিম মৌলবাদীরা মেঘালয়কে মুসলিম স্টেট বানাতে চায়। তারা লাগামহীনভাবে সন্তান জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। গোটা উত্তর পূর্ব ভারতে তাদের বিপদজনক শ্লোগান হোল চাকরি চাই না, সন্তান চাই। ধর্ম নিরপেক্ষ মুসলিম ভাইবোনরা এদের সামনে অসহায়। ফলে গোটা উত্তর পূর্ব ভারতে বিশেষ করে, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে খাসিয়া সহ সব আদিবাসিন্দা উপজাতিরা অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কায় ভুগছে।
একটু থেমে বিষ্ণু বলল–স্যার, আমি খৃষ্টান মিশনারী স্কুলে চাকরি করি। তবু বোলবো, সব খৃষ্টান মারিয়া নয়, কিংবা মিস্টার ও মিসেস বেঞ্জামিন যোসেফ নন; অথবা যিনি আমার এই স্কুলে চাকরিটা করে দিয়েছিলেন, সেই মারিয়ার দূর সম্পর্কের মামা টম ডেভিডের মতো উদার নন। বরং অধিকাংশ মিশনারী প্রতিষ্ঠান ধর্মান্তকরণের আখড়া। এদেশের, এ রাজ্যের মানুষদের সীমাহীন দারিদ্র্য ও তার প্রতি সরকারী ঔদাসীন্যের সুযোগে মিশনারীগুলি ঢালাওভাবে তাদেরকে অর্থনৈতিক সুবিধাবলী দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করে খৃষ্টান ধর্মে তাদেরকে দীক্ষিত করছে। উপজাতিদের সুসমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়। ধর্মান্তর করার পর তাদের মধ্যে ভারত বিরোধী বিদ্বেষের তথা বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতার বীজ ছড়াচ্ছে।
গোটা উত্তর পূর্ব ভারত জুড়ে বিশেষ করে মেঘালয়ে যে অস্থিরতা ও জাতিদাঙ্গা, সেসব হোল এগুলিরই এক জটিল রসায়ন। পশ্চিমবাংলা থেকে বহুদূরে এই জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কোলে আমায় একদিনকার ছাত্রী আজ আমার ছায়াসঙ্গিনী। আমার সকল সত্তা দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা মারিয়াকে পাশে নিয়ে এই জাতিদাঙ্গার বিরুদ্ধে, জাতীয় সংহতির পক্ষে ক্ষুদ্র পরিসর হলেও, সুসংগঠিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। স্যার হৃদয়ভরা ভালোবাসা থাকলে, আর ভালোবাসার মানুষটার মূল্যবোধের প্রতি ত্যাগের মানসিকতা থাকলে, সহনশীলতার মনোভাব থাকলে সব কর্মে যে, সব বাধা অতিক্রম করা যায়, আমি ও আপনার বৌমা তো স্যার তার বড় প্রমাণ। পড়াতে পড়াতে, পড়তে পড়তে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে যখন ঘর বাঁধতে এগোলাম, তখন ধর্মীয় কত বাধা। কিন্তু ঠিক তো পেরিয়ে গেলাম: মারিয়াকেও হিন্দু হতে হয়নি, আমাকেও খৃষ্টান না। বরং দেখুন স্যার, উদার দৃষ্টিতে ধর্মকে দেখে, কিষ্টো আর খীষ্টো উভয়কেই একই পূজোর সিংহাসনে রেখে, জন্মাষ্টমী-বড়োদিন, উভয়পরবে সবাইকে ডেকে কেমন সুন্দরভাবে আমরা আছি।
— আচ্ছা বিষ্ণু, তোমাদের মধ্যে খাদ্যাভাস নিয়ে কোন সমস্যা হয় না?
–না স্যার। ঐ যে বললাম, ভালোবাসার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমি ও মারিয়া উভয়েই উভয়ের জন্য ত্যাগ স্বীকারে সব সময়েই প্রস্তুত থেকেছি। আমি জীবনে কখনও গরু বা শূয়োরের মাংস খাইনি। কিন্তু, মারিয়ার জন্য বাড়ীতে এটা তোলার ব্যবস্থা করতে মারিয়াই আড় হয়ে পড়লো। সে স্বেচ্ছায় ওটা খাওয়া ছেড়েই দিল। আর, এই দুটো খাদ্য ছাড়া, আর সবই তো Common food।
–আশ্চর্য! মেয়েটার কি গভীর ভালোবাসা বোধ, কি উন্নত রুচি! বিষ্ণু তুমি সত্যিই ভাগ্যবান।
–সে জানি না স্যার। তবে এইটা জানি যে মারিয়া আমার গর্ব, আমার অহংকার। আমরা দু’জনে উদ্যোগ নিয়ে টেগোর সোসাইটি বলে একটা ছোট্ট Cultural Forum গড়েছি। বছর দুই হোল সংস্থাটির বয়স। ইতিমধ্যে মেঘালয়ে এর চারটি ইউনিট হয়েছে। বাঙালী, খাসিয়া, খৃষ্টান, হিন্দু, মেল, ফিমেল এর সভ্যসংখ্যা ফাইভ হানড্রেড ছাড়িয়ে গেছে স্যার। এর কাজ হোল কি খৃষ্টান, কি হিন্দু, সব fundamentalism-এর বিরুদ্ধে fight করা এবং আমরা সবাই যে ভারতবাসী, এই বোধ সবার মধ্যে জাগিয়ে তোলা, বিশ্বভ্রাতৃত্বের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করা। একটু থেমে বিষ্ণু বোললো, আপনার বৌমা স্যার খুব ভালো গান জানে। নিজের কণ্ঠে গাওয়া “সারে জাহা সে আচ্ছা” ইত্যাদি গানের ক্যাসেটগুলি বাজিয়ে বিশেষ করে মহিলাদেরকে ও আকর্ষণ করে। জানেন স্যার, এই শিলং শহরে মারিয়ার উদ্যোগ, লেখাপড়া জানা মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে একটা দারুণ positive effect ফেলেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থাবাকে অনেকখানি ভোঁতা করে দিয়েছে ও দিচ্ছে ওর তথা Tagore Society-র উদ্যোগ।
কথা বলতে বলতে বেলা পড়ে এলো। আঁধার নামলে পাহাড়ী পথে গাড়ী চালানো বিপদজনক। তাই ড্রাইভার এসে তাড়া লাগালো।
–হ্যাঁ স্যার। আর আপনাকে আটকাবো না। বিষ্ণু তার বসার চেয়ার-টেবিলের সঙ্গে সেট করা সুইচটা অন করে দিল: বিদায়কালে স্যারকে প্রণাম জানালো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে–
” আগুনের পরশমণি
জ্বালাও প্রাণে,
এ জীবন পূর্ণ করো,
এ জীবন পূর্ণ করো
দহন দানে।”
সজল চোখে স্যার বিদায় নেওয়ার আগে আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–তুমি বলছিলে না বাবা, আমার মারিয়া মা তার গলায় গাওয়া “সারে জাঁহা সে আচ্ছা” ইত্যাদি গানের ক্যাসেট শুনিয়ে এই জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মানুষদেরকে জাতীয় সংহতিতে উদ্বুদ্ধ করে
–হ্যা স্যার।
–তুমি আমার মায়ের গাওয়া ওই “সারে জাঁহা সে আচ্ছা”-র ভিডিওটা আমার মোবাইলে ফরওয়ার্ড করে দাও, পরে অন্যগুলিও দিও।
জিপসি ছেড়ে দিল।
ড. রায় মারিয়ার গাওয়া ভিডিওটা ছেড়ে দিলেন–
“সারে জাঁহা সে আচ্ছা, ইয়ে হিন্দোসিতাঁ হামারা
হাম বুলবুলে হ্যাঁয় ইসকী ইয়ে গুলসিতাঁ হামারা।
***************X**************

One thought on “Khansia Paharer Dhale (খাঁসিয়া পাহাড়ের ঢালে) – Written by Khagendranath Adhikary”
  1. Hey there! This is kind of off topic but I
    need some guidance from an established blog. Is it hard to set up your own blog?

    I’m not very techincal but I can figure things out pretty fast.
    I’m thinking about setting up my own but I’m not sure where to begin. Do you have any ideas or suggestions?

    Appreciate it

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *