Spread the love

ভ্রমণ কাহিনি হিমালয়ের কোলে গ্যাংটক

মার্চ মাসের ১৫ তারিখ কোলকাতার আবহাওয়াতে গরম আগত প্রায়। সেদিন রাতের দার্জিলিং মেলে অফিসের কাজ নিয়ে গ্যাংটক যাবার কথা। সকাল বেলা অফিস গিয়ে জানতে পারলাম গ্যাংটক যেতে হবে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে কিছুক্ষন পর বেড়িয়ে গেলাম শিয়ালদহের উদ্দেশ্যে। রাত ১০টা০৫ মিনিটে ট্রেন।  তাই একটু আগে পৌঁছে রাতের খাবার সেরে উঠে পড়ব ট্রেনে।
৯বি প্ল্যাটফর্ম এ দার্জিলিং মেল এসে দাড়াল আমি এস৭ কামরাতে উঠলাম। ২৪ নং সিটটা ছিল নিচে জানালার পাশে। ব্যাগটাকে মাথার নিচে দিয়ে চাদর টাকে হাল্কা ভাবে জড়িয়ে, নিয়ে জানালা দিয়ে আসা হাল্কা শীতল হাওয়াকে সঙ্গী করে দিলাম এক ঘুম। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল আটটা। তখন ও ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছায় নি। টিটি কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আট টা কুড়ির মধ্যে পৌঁছে যাব। তাই আর দেরী না করে ফ্রেস হয়ে নিলাম।  নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম ঠিক আটটা পঁচিশ মিনিটে।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে ৩০০ টাকা দিয়ে গ্যাংটকে যাবার জন্য সুমো ভাড়া করলাম। প্রথম যাচ্ছি তাই মনের ভেতরে এক আনন্দ মিশ্রিত উত্তেজনা কাজ করছিলো। সুমো দশ জন যাত্রী নিয়ে রওনা দিল গ্যাংটকের  উদ্দেশ্যে।  কিছুদুর গিয়ে আমাদের গাড়িটা সেবক রোডে উঠল। ঝা চকচকে রাস্তাতে যেন ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলতে লাগলো। রাস্তার দুধারে সবুজের সমারোহে মনটা নেচে উঠলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের শিখরদেশ। তার উপর বিছিয়ে আছে হাল্কা বরফ রাজি। মনে হচ্ছে হিমালয় যেন রুপালী চাদরে মুড়ে আছে। সেবক কালী মন্দির পার করে পাহাড়ি রাস্তাতে আমদের গাড়ি চলতে লাগলো।  অন্য যাত্রীরা মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত আর আমার চোখ উপভোগ করছে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যতাকে। পাহাড়ি রাস্তায় কিছুটা যেতেই দেখলাম আকাশ  মেঘাচ্ছন। প্রকৃতি সেজেছে যেন এক নতুন রূপে। দেখে মনে হচ্ছে, নব বিবাহিত কন্যা যখন আপন আলয় ছেড়ে তার পতির ঘরের দিকে যাত্রা করে সেই সময় তার যা মুখের অবয়ব থাকে ঠিক সেই রকম। হঠাৎ ই নব বঁধুর চোখের থেকে গড়িয়ে পড়া জলের মতো টিপটিপ করে শুরু হল বৃষ্টি। সাথে দোসর হলো ঠান্ডা হাওয়া। বেশ ঠান্ডা লাগছে দেখে ব্যাগ থেকে বের করলাম জ্যাকেট আর টুপি। জম্পেস করে ঠান্ডার সাথে বৃষ্টি আর প্রকৃতিকে উপভোগ করছি। সেই সময় চোখে পড়ল মমনমোহিনী তিস্তা। প্রেমে পরে গেলাম ওর। পাহাড়ের গা দিয়ে বয়ে চলা তিস্তাকে কখন মনে হচ্ছে কুমারী  আবার কোন বাঁকে  মনে
হচ্ছে ঋতুমতী নারী আবার কোথাও বা সদ্য বিবাহিত নারী। নানা রুপে ভুলিয়ে নিয়ে চলেছে আমাকে। মাঝে বেড়েছে বৃষ্টির ফোটা। একটা
বৃষ্টির ফোটা যখন তিস্তার বুকে পড়ছে মনে হচ্ছে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সুন্দরী তিস্তাকে বিদ্ধ করছে তার বৃষ্টির ফলায়। বিদ্ধস্ত তিস্তা যেন বারবার খোচা খেয়ে আঁতকে উঠছে। প্রতিটা মুহুর্তে মনমোহিনী আমার তিস্তা। ঘড়ির কাটা তার খেয়ালে ঘুরে চলেছে খেয়াল নেই শুধু আমার। আমি যে তিস্তা আর মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি খেলার সাথে আমার মনকে মিশিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ আমাদের গাড়িটা জোড়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা বাঁকে এসে। এই প্রথম ঘোর কাটলো আমার। গাড়ির চালক বলল এক্সেল ভেঙে গেছে তাই অন্য গাড়িতে যেতে হবে। গাড়ি থেকে নামতেই বৃষ্টির আশির্বাদি ফোঁটা আমার টুপি ভেদ করে মাথায় পড়ছে। ঠান্ডাটা এবার বেশ অনুভব হচ্ছে। চায়ের জন্য এতক্ষনে মনটা কেঁদে উঠল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে সামনের একটা ছোট্ট দোকান থেকে চা আর সাথে একটা কেক কিনে খেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম বন্ধুদের সাথে আসলে কতো না মজা করতে পারতাম।  আমার মনে হল বন্ধুদের সাথে না এসে ভালোই হয়েছে তাহলে আর আমার মনমোহিনীকে এভাবে দেখা হতো না।

এবার অন্য একটা অল্টো পেলাম। সেটা তে উঠে চালকের পাশের সিটাতে বসলাম। আর উপভোগ করতে থাকলাম প্রকৃতিকে। কিছুক্ষন পর সিকিম বর্ডারে এসে পৌছালাম।  পুলিশ আমাদের গাড়ির প্রতিটি যাত্রির বৈধতার কাগজ পত্র দেখে নিয়ে ছেড়ে দিল। গাড়ি চলতে লাগলো  পাশে খাদ, পাহাড় আর তার গায়ের ঘড় বাড়িকে পাশ কাটিয়ে । সেগুলো যেন আমাকে ডাকছে। আলিঙ্গন করে নিতে চাইছে বলছে, এসো আমার কাছে আমাকে জড়িয়ে নাও তোমার বাহু ডোরে। গাড়ি খারাপ হবার ফলে অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেছে। মেঘের আড়াল চিড়ে বিকেলের পরন্ত রবির রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। যেন মনে হচ্ছে বিজয়ার সিঁদূর খেলে আসা নব বধুর মতো।  মুগ্ধতা আর  বিশ্বয় নিয়ে এগিয়ে চললাম গ্যাংটকের দিকে। ঘড়ির কাটা সবে পাঁচটা ছুঁয়েছে, আর আমার পদার্পণ হল গ্যাংটকের এমজি মার্গের পাদদেশে।  আবার বৃষ্টি শুরু সাথে হাল্কা হাওয়া শুরু হলো।  কখন যে আকাশের মুখ ভার হয়েছে বুঝতেও পারিনি। ঠান্ডার পারদ পড়তে লাগল। খুব ঠান্ডা লাগছিল। ভিজতে ভিজতে  আমার অফিসের বুক করা হোটেলে  আসলাম। ব্যাগটা রেখে  বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে নিয়ে রুমে আসলাম। গরম জলে স্নান সেরে  রুমে এসেই কম্বলের নিচে ঢুকে পরলাম। ঠান্ডায় হাত পা যেন জমে যেতে লাগলো।  রুম সার্ভিসে ফোন করে কফি আর  চিকেন পাকোড়া  অর্ডার করলাম। খিদেটা এবার টের পেলাম। দশ মিনিটের মধ্যে আমার অর্ডার দিয়ে গেল। খেয়ে নিলাম পেটটাও ঠান্ডা হল আর কফিটা পেটে যাবার পর শরীর টাও একটু গরম হল।আরও কিছুক্ষণ কম্বলের ভেতর কাটিয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বের হলাম এমজি মার্গের দিকে। পাহাড়ি রাস্তায় একটু খানি উপরে উঠলেই এমজি মার্গ। বৃষ্টি আর নেই চাঁদের দেখা মিলেছে সবে মাত্র। তবে ঠান্ডায় রাস্তায় চলতে ইচ্ছে করছে না।তবুও নতুন জায়গা তাই দেখার নেশায় এমজি মার্গ পৌঁছে গেলাম। কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত শরীর আর পাহাড়ের গায়ের অন্ধকার কে সঙ্গে করে ফিরে এলাম হোটেলে। খেয়ে নিয়ে আমার কম্বলকে আপন করে পরের দিনের অফিসের কাজ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম । 
ঘুম ভালো হলো না, এক অফিসের কাজের চিন্তা আর একদিকে ভোরের হিমালয়কে দেখার অদম্য ইচ্ছে।সবে ভোর হয়েছে সূর্যর দেখা নেই। আমি ভালো করে গরম জামা চাপিয়ে শীতলতার মজা নিতে নিতে চললাম এমজি মার্গ এর দিকে দূরে কাঞ্চন জঙ্ঘার চুড়া দেখা যাচ্ছে পুরো বরফে ঢাকা। এবার নির্মল আকাশে দেখা দিল হাল্কা রোদের দেখা। যেই উদিত সূর্যর আলো পড়ল কাঞ্চন জঙ্ঘার উপর সে এক অপরুপ শোভা। রুপোলী চাদরের উপর আলো পরে ঠিকরে বের হচ্ছে সে এক প্রকৃতির অপরুপ শোভা।  চলতে চলতে সিকিম রেডিও স্টেশনের কাছে চলে এলাম। সময় বলছে সকাল ৭ টা। প্রকৃতি কে দেখতে দেখতে  পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা নিয়ে,অপরূপ রূপ দেখতে লাগলাম।  চায়ের দোকান বলতে একজন নেপালী মহিলা দুটো বড় ফ্লাক্স করে চা নিয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে বিক্রি করছে পর্যটকদের।   আরও কিছুক্ষণ থেকে ভাড়া ক্রান্ত মনে হোটেল ফিরে এলাম কাজের তাগিদে। হোটেলে এসে  স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের কাজে। রাতে ৮ টায় ট্রেন তাই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেলা তিনটের সময় ভাড়াক্রান্ত মনে প্রেয়সীর রূপের ঢালি দেখতে দেখতে নেমে এলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।  গন্তব্য সেই আমার কোলকাতা।

*বানীব্রত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact for Advertisers, Readers and Writers : email: info@kabyapot.com Whatsapp: 8240042145