Spread the love

 

পরদিন সূর্যোদয়ে পাণ্ডুপুত্রগণ,
সর্বশত্রুজয়ী ব‍্যূহ করেন রচন।।
অর্জুন, অভিমন্যু, সাত‍্যকি, চেকিতান,
রক্ষিতে নানা স্থানে করেন অবস্থান।।
শিখণ্ডী রহিলেন তিনি অগ্রে সবার।
নকুল, বিরাট গেলেন পশ্চাতে তাঁর।।
ভীষ্ম রহিলেন কৌরব সেনার আগে।
অশ্বত্থামা, কৃপ, দ্রোণাদি পশ্চাদভাগে।।
শিখণ্ডীরে অগ্রভাগে করিয়া স্থাপন,
অর্জুন পিতামহে করেন আক্রমণ।।
ভীম, সাত‍্যকি প্রভৃতি মহারথগণ,
কুরুসেনা হানিবারে করেন গমন।।
ত‍্যজি জীবনের আশা ভীষ্ম সেনাপতি,
করেন যুদ্ধ ধনুর্বাণে ভয়ঙ্কর অতি।।
রথী, মহারথী, অশ্ব, গজ কত শত,
আজি এই মহারণে হইলেক হত।।
শিখণ্ডী ভীষ্মে করেন তীব্র শরাঘাত।
ভীষ্ম শিখণ্ডী প্রতি করেন দৃষ্টিপাত।।
কহিলেন, শিখণ্ডী মোর কথা শোন,
তোমা সনে যুদ্ধে মোর রুচি নাই কোন।।
শিখণ্ডী হইয়া তুমি হইলে স্ত্রীজাতি।
তোমারে বধিলে আমি ঘৃণ্য হইব অতি।।
তাই করিব না যুদ্ধ আমি তব সনে।
যদিও আঘাত হানো তুমি এক্ষণে।।
কহিলেন শিখণ্ডী, অজ্ঞাত নহে মম,
মহাবাহু, ভয়ঙ্কর তব পরাক্রম।।
তবু সাধিতে স্বীয় আর পাণ্ডব হিত,
আজি এই সমরে তুমি হইবে হত।।
কহেন অর্জুন, ভীষ্মে কর আক্রমণ,
শিখণ্ডী তোমারে আমি করিব রক্ষণ।।
ভীষ্মে হানিতে আজ যদি কর ভুল,
উপহাস করিবে তখন যত ক্ষত্রকুল।।
কুরুসেনা ত্রস্ত অর্জুন শর বর্ষণে,
হইয়া ভয়ে ভীত তারা ব‍্যস্ত পলায়নে।।
হেরিয়া তাহা দুর্যোধন উদ্বিগ্ন মন।
ভীষ্ম পিতামহে তিনি কহেন তখন।।
অর্জুন বিনাশে মোর সেনা দলে দলে,
অরণ্য দগ্ধে অনল যথা গ্রীষ্মকালে।।
ভীম সাত‍্যকি আর নকুল সহদেবে,
অভিমন্যু ঘটোৎকচ ধৃষ্টদ‍্যুম্ন সবে,
করে যথেচ্ছ মোদের সেনা নিপীড়ন।
আপনি তাদের রক্ষা করুন এখন।।
চিন্তিয়া মুহূর্তকাল ভীষ্ম তাঁরে কন,
করেছিলাম পণ আমি শোন দুর্যোধন।।
দশ সহস্র সেনা রোজ করিব হনন।
অতঃপর ত‍্যজিব এই রণাঙ্গন।।
এখন হইল সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ।
আর আজি এক কর্ম করিব সাধন।।
হইয়া নিহত রণভূমে করিব শয়ন।
নতুবা পাণ্ডবগণে করিব নিধন।।
রাজা, মোরে অন্ন দান করিলে এতদিন,
হইয়া নিহত আজি শোধিব সে ঋণ।।

ভীম নকুল বিরাট আর যুধিষ্ঠির,
ঘটোৎকচ অর্জুন পশ্চাতে শিখণ্ডীর।।
আরও অনেকে সবাই আছেন যত,
বধিতে ভীষ্মে সবে হইলেন ধাবিত।।
অলম্বুষ অশ্বত্থামা দ্রোণ দুঃশাসন,
সকলে উদ্বিগ্ন ভীষ্মে করিতে রক্ষণ।।
অশ্বত্থামায় কহেন তাঁর পিতা দ্রোণ,
যুদ্ধে দেখি আমি আজ নানা দুর্লক্ষণ।।
ভীষ্ম অর্জুন আজ যুদ্ধে তাঁরা মিলিত,
ভাবিয়া এক্ষনে আমি হলাম চিন্তিত।।
রয়েছে শিখণ্ডী বসে অর্জুন সম্মুখে,
ভীষ্ম ত‍্যজিবেন অস্ত্র হেরিয়া সম্মুখে।।
শিখণ্ডী ছিলেন স্ত্রীজাতি এই কারণে,
বিরত রহিবেন তিনি অস্ত্র ধারণে।।
অর্জুন ভয়ঙ্কর হইলে গাণ্ডীব ধারী,
হইবে যুদ্ধ আজ জগৎ প্রলয়কারী।।
পরাশ্রিতে রক্ষার সময় ইহা নয়,
যুদ্ধে যাও লভিতে স্বর্গ যশ বিজয়।।
কৃষ্ণাশ্রয়ে অর্জুন করে সেনা মর্দন।
করিছে যুদ্ধ সে এক অতীব ভীষণ।।
না থাকিও বৎস তুমি অর্জুন পথে।
যুদ্ধ কর শিখণ্ডী ধৃষ্টদ‍্যুম্নের সাথে।।
সন্তানের দীর্ঘ জীবন চাহে সকলে।
তথাপি বিচারি স্বধর্ম যাও রণস্থলে।।
*
দশদিন পাণ্ডব দল করিয়া পীড়ন,
ভীষ্ম রাখিতে নাহি চান নিজের জীবন।।
হত্যা আর নাহি করিতে করেন মনস্থির।
হেন কালে সম্মুখে দেখেন যুধিষ্ঠির।।
কহিলেন তিনি তাঁরে দুঃখিত মনে,
কিছু জরুরী কথা আছে তব সনে।।
হয়েছে বিরাগ মম এই দেহ ‘পরে।
বধিলাম অসংখ্য প্রাণী এই সমরে।।
অর্জুন সচেষ্ট হোক মোরে বধিবারে।
বৎস এই কথা আমি কহি তোমারে।।
*
অর্জুন সম্মুখে রাখিয়া শিখণ্ডীরে,
আইলেন বধিতে ভীষ্মে সম্মুখ সমরে।।
ভীষ্ম তখন এই চিন্তা করিলেন মনে,
মৃত্যুর সঠিক কাল আইল এক্ষণে।।
হেন ভীষ্ম ইচ্ছা করিয়া অনুধাবন,
আকাশবাণী করেন বসু ঋষিগণ।।
বৎস তব ইচ্ছায় হইলাম প্রীত।
এক্ষণে এ যুদ্ধ হইতে হও বিরত।।
বহিল সুগন্ধ সিক্ত পবন তখন,
বাজিল দেবদুন্দুভি পুলকিত মন।
হইল সঘন পুষ্পবৃষ্টি ভীষ্ম ‘পরে ।
সঞ্জয় জ্ঞাত শুধু ব‍্যাসদেবের বরে।।
*
ত‍্যজিলেন ভীষ্ম যুদ্ধে তাঁর ধনুর্বাণ।
শিখণ্ডী নিক্ষেপিলেন নয় তীক্ষ্ণ বাণ।।
সেই বাণে ভীষ্ম হইলেন তীব্র আহত।
আঘাতে ভীষ্ম তবু না হন বিচলিত।।
অর্জুন শত বাণ করিলে নিক্ষেপন,
ভীষ্ম ঈষৎ হাস‍্যে দুঃশাসনে কন।।
এই সকল বজ্রতুল‍্য মর্মভেদী বাণ,
শিখণ্ডীর নয়তো এ সব অর্জুন বাণ।।
ভীষ্ম অর্জুন প্রতি শক্তিঅস্ত্র হানে,
ত্রিখণ্ডিত সেই অস্ত্র অর্জুনের বাণে।।
খড়্গ ঢাল লয়ে ভীষ্ম উদ‍্যোগী রণে,
শত খণ্ডে খণ্ডিত ঢাল অর্জুন বাণে।।
যুধিষ্ঠির আদেশে পাণ্ডব সেনাগণ,
চতুর্দিকে ভীষ্মেরে করেন আক্রমণ।।
পঞ্চপাণ্ডব বাণে হইয়া নিপীড়িত,
কৃপ শল‍্য ভীষ্মে ত‍্যজি সবে পলাইত।।
ভীষ্মে বিদ্ধ করিল কত শত শত বাণ।
রহিল না অবিদ্ধ ইঞ্চি পরিমান স্থান।।
শরাঘাতে ভীষ্ম হইয়া ক্ষত বিক্ষত,
সূর্যাস্ত পূর্বে তিনি হলেন ভূপতিত।।
ভীষ্ম শরীর শত শত শরে আবৃত।
তাই ভূমে নয় দেহ শরেতে শায়িত।।
দক্ষিণায়নে ছিলেন রবি সেই ক্ষণে।
তাই হেরি কহিলেন সব দেব গণে।।
নরশ্রেষ্ঠ গাঙ্গেয় আপনি এই কালে,
কেমনে ত‍্যজিবেন প্রাণ ঘোর অকালে।।
সূর্যের উত্তরায়ন হইবে যখন,
সেই কালে মোর প্রাণ ত‍্যজিব তখন।।
ভীষ্ম কন ততদিন এ শর শয্যায়,
রহিব আমি উত্তরায়ন প্রতীক্ষায়।।
শোকাকুল কুরুকুল করিল শোচন।
কৃপ দুর্যোধন সবে করেন রোদন।।
ভীষ্ম শায়িত রহিলেন শর শয্যায়।
মহোপনিষৎ জপেন মৃত্যু প্রতীক্ষায়।।
(ক্রমশঃ)

2 thoughts on “ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য:– * কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন * উপস্থাপন–১০ ( পূর্ব প্রকাশিতের পর ) ★দশম দিনের যুদ্ধ★ (ভীষ্মের পতন) – কবি কৃষ্ণপদ ঘোষ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact for Advertisers, Readers and Writers : email: info@kabyapot.com Whatsapp: 8240042145