Spread the love

প্রবন্ধ – *ঈশ্বরচন্দ্র* 

প্রথম পর্ব –

 

✍️ *শৌভিক*

 

বিদ্যাসাগর ও পরমহংস দেব –

 

“মন কী তত্ত্ব করো তাঁরে

 

যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে

 

সে যে ভাবের বিষয়ে

 

ভাব ব্যতীত অভাবে

 

কী ধরতে পারে।”

 

ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কে এই গানটি শুনিয়েছিলেন ওনার সাথে দেখা করার সময় এবং ঠাকুর ভাব সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিলেন গান গাওয়ার সময়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় একদৃষ্টিতে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গান শেষে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রামকৃষ্ণ দেব হেসে বলেছিলেন, “রামপ্রসাদ মনকে বলেছে ঠারে ঠোরে বুঝতে। এই বুঝতে বলেছে যে বেদে যাকে ব্রহ্ম বলেছে, তাঁকেই আমি মা বলে ডাকছি। তিনি নির্গুণ, তিনিই সগুন, তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি।” গানের মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে, ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, অমরত্বের দিকে এগিয়ে চলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। বিবিধ গুনের সমাহার হলে তবেই অমরত্ব লাভ করা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এমনই সশ্রদ্ধ ছিলেন ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব মহাশয়।

 

বিদ্যাসাগর বনাম বঙ্কিমচন্দ্র বিবাদ –

 

ঘটনার সূত্রপাত ১৮৫৮ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি,এ পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলায় ফেল করেছিলেন। যেই বঙ্কিম আগের সব পরীক্ষায় ভালো ভাবে পাশ করেছিলেন, সেই তিনিই বাংলায় ফেল করেছেন।স্বভাবতই তাঁর মন খারাপ মেজাজ খুব খারাপ। বাংলায় ৭ নম্বর কম পেয়েছিলেন তিনি এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় ওনাকে গ্রেস দিয়েছিল। কারণ যাঁরা ফেল করেছিলেন তাদের মধ্যে বঙ্কিমের স্থান ছিল প্রথম। বঙ্কিমই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক। ওনার খাতা দেখেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেস দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ,যে যেই নম্বর পাওয়ার যোগ্য , তাকে তাই দেওয়া হয়েছে। সেই পরীক্ষা কলকাতার টাউনহলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেই কাজই করেছেন বঙ্কিম তার বিরোধিতা করেছেন চোখ বুজে।

 

বিধবা বিবাহের কথাই যদি ধরা হয় – ১২৭৯ বঙ্গাব্দে “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমের “বিষবৃক্ষ”, যেখানে সূর্যমুখী একটি চিঠিতে লিখছে, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় এক বড় পণ্ডিত আছেন। তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বই বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয় সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে? ”

 

বিদ্যাসাগর মহাশয়ও এর প্রতি-উত্তর দিয়েছিলেন বর্ধমানের তারকনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে। তিনি তারকনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন একবার। নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াবেন লোকজন কে সেই ইচ্ছা। খাবারের তালিকায় ছিল – ভাত, পাঁঠার মাংসের ঝোল আর আম আদার অম্বল | নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানতেন না যে রান্না কে করেছেন। খেতে খেতে জানালেন যে, এতো সুস্বাদু অম্বল তিনি আগে কখনো খান নি। উপস্থিত সঞ্জীবচন্দ্র জানালেন বিদ্যাসাগরের নাম। শুনে চুপ করে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র এবং হাসতে হাসতে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন যে, বঙ্কিমের সূর্যমুখী তো নাকী তার মত আমার মতো মূর্খ দেখেই নি ! বঙ্কিম কোনো উত্তর দেননি ,তবে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল খাওয়া-দাওয়ার জায়গায়।

 

ঈশ্বরচন্দ্র নিয়মকরে সাহিত্য সভায় যাওয়া আসা করতেন এবং এক জায়গায় দেখা হল বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে। বঙ্কিমের পরনে ছিল শৌখিন পোশাক আর বিদ্যাসাগরের গায়ে খদ্দরের চাদর আর পায়ে শুঁড় তোলা চটি।বিদ্যাসাগরের চটির দিকে চোখ যেতেই বঙ্কিম আঙুল দিয়ে বললেন যে, পণ্ডিত মহাশয়ের চটির শুঁড় তো ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে, শেষে মাথায় না গিয়ে ঠেকে ! রসিক বিদ্যাসাগরও বঙ্কিমকে রসিকতার সাথে হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, “কী আর করা যায় বলো। চট্টরা যতই পুরনো হয় ততই দেখি বঙ্কিম হয়ে ওঠে।” কিন্তু এই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্রই লিখেছেন , ” সমাজসংস্কারের পক্ষে অমন সাহসী পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যায় না। পাণ্ডিত্য, দানশীলতা এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। ”

 

রসিক ঈশ্বরচন্দ্র –

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে আলোচনায় তাঁর অসীম ব্যক্তিত্ব, প্রখর বুদ্ধির সাথে যে অসাধারণ রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনই কিছু ঘটনার কথা বলা যাক –

 

বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি কখনই ছাত্রদের মারধর করার বিষয়টা পছন্দ করতেন না। প্রায় দিনই ক্লাস চলাকালীন সারা কলেজে টহল দিয়ে বেড়াতেন তিনি। একদিন একজন অধ্যাপকের টেবিলের উপর বেত রাখা আছে দেখে, তিনি অধ্যাপককে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে, বেত নিয়ে ক্লাসে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। অধ্যাপক বললেন, ম্যাপ দেখানোর সুবিধার জন্য ওই জিনিসটি নিয়ে যান তিনি। বিদ্যাসাগর মহাশয় হেসে বললেন যে তিনি বুঝে গিয়েছেন, রথ দেখা এবং কলা বেচা দু’টোই হবে একসাথে। ম্যাপ দেখানোও যাবে আবার প্রয়োজন হলে ছাত্র ঠেঙানোও চলবে !

 

একদিন ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের কাছে এক গোঁড়া ব্ৰাহ্মণ দেখা করতে এসেছেন। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কেউই এই অপরিচিত ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণাম করেন নি। এই ব্যবহারে ব্ৰাহ্মণ রাগে অপমানে বলেন যে, এইসব অর্বাচীনদের মনে রাখা উচিত যে, ব্ৰাহ্মণেরাই বর্ণশ্রেষ্ঠ, বেদজ্ঞ জ্ঞানী, এক সময় তাঁরাই দেশ ও ধর্মের কল্যাণ সাধন করেছেন। এই কারণেই তাঁরা সব সময় সব জায়গায় সকলের প্ৰণম্য। দেখা হওয়ার পরই সকলেরই তাঁদের প্রণাম করা উচিত। একথা শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় হেসে বলেছিলেন, “পণ্ডিত মশাই, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ একসময় বরাহরূপ (শূকরের চেহারা) ধারণ করেছিলেন, তাই বলে কী ডোমপাড়ায় যত শূকর আছে, তাদের প্রণাম করতে যাবো ?”

 

ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট ছেলে ঈশানচন্দ্র এবং বড় নাতি অর্থাৎ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ছেলে নারায়ণকে অত্যাধিক পরিমানে স্নেহ করতেন ! ফলে বাড়ির অন্য কারোর শাসন চলত না ওই দুজনের ওপর। দিনের পর দিন এমন অবস্থা দেখে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের পিতৃদেবের মুখোমুখি হয়ে অনুযোগের স্বরে বললেন যে, তিনি তো একজন নিরামিষাশী মানুষ, তাহলে ঈশান এবং নারায়ণের মাথা খাচ্ছেন কী করে !

 

এক সাব-জজের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সংবাদ শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাকে বলেছিলেন, “তোমার তো মরার পরেই স্বৰ্গবাস ! কেন ? আমরা মরলে কিছুদিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করে তারপর স্বর্গে যাব কিন্তু তুমি এখন নরক ভোগ করবে। ফলে মরার পর সরাসরি স্বৰ্গে যাবে।”

 

একবার একজন ধনী লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্ৰিয় শখ ছিল বই পড়া এবং সেগুলো যত্ন করে বাঁধাই করে তুলে রাখা। ভদ্রলোক বইগুলো দেখে বললেন, এত খরচ করে বইগুলো বাঁধিয়ে না রাখলেও তো হতো। ঐ টাকায় অনেকের উপকার হতে পারত। বিদ্যাসাগর তামাক খেতে খেতে ভদ্রলোকের শাল লক্ষ্য করে বললেন, আপনার শালটি বেশ চমৎকার ! কোথা থেকে, কত টাকা দিয়ে কিনেছেন ? শালের প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন যে তিনি শালটি পঁচিশ টাকায় কিনেছেন। বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, পাঁচ সিকের কম্বলেও তো শীত আটকায়, তবে এত টাকার শালের প্রয়োজন আছে কী ? এ টাকাও তো অনেকের উপকারে আসতে পারত।

 

তিনি একবার গ্রামের এক স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছেন। সেখানে এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে খেতে বসে রান্নার বিশেষ প্রশংসা করতে লাগলেন। সে সময় ওই গ্রামেরই এক ধনী ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও পরেরদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় কে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নানা রকম দামী খাবার পরিবেশন করলেন। বিদ্যাসাগর খাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু রান্নার প্রশংসা করছেন না দেখে হতাশ সেই ধনী গৃহকর্তা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খাবার কী ভালো হয় নি ?

প্রতিউত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বললেন –

 

ভালোই তবে ময়ান কম হয়েছে।

 

ভদ্রলোক অবাক হলেন , কিসের ময়ান ?

 

বিদ্যাসাগর মুচকি হেসে বললেন, মনের ময়ান।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন। শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বর চন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে প্রায়ই হিন্দু কলেজের এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন, “কি হে, বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতিদিন এইধরনের বাঁকা কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একইভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন, সেই ইংরেজের সাথে দেখা এবং আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর চাদরের কোনায় বেঁধে রাখা একটা কয়েন বের করে বললেন, “এই যে এটা রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগেনা। এবার হলো তো ?” ইউরোপের রেনেসাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাজা রামমোহন রায় ধর্মীয় সংস্কারের দ্বারা এইদেশে রেনেসাঁ যে শুভারম্ভ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র সেই আন্দোলনকেই শতদলে বিকশিত করে ত্বরান্বিত করেছিলেন এ কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেই হয়।

 

বেথুন কলেজ –

 

বিদ্যাসাগর মহাশয় একবার বন্ধুবর মদন মোহন তর্কালংকারের বাড়ি গিয়ে দেখন, মদন মোহন বাবুর দুই কন্যা বেথুন সাহেবকে ঘোড়া বানিয়ে তাঁর পিঠের ওপর বসে খেলা করছে। বিদ্যাসাগর বললেন “আরে করেছো কী তোমরা, বেথুন সাহেবের মত এতবড় একজন ব্যারিস্টারের পিঠে চড়ে তোমরা খেলা করেছো?” সাহেব হেসে বললেন, “শুধু ঘোড়া কেন ওরা যদি চায় আমি পাখি হয়েও ওদের নিয়ে উড়ে যেতে পারি। কারণ ওরা আমার স্কুলে পড়তে রাজি হয়েছে।” উত্তর কলকাতায় অবস্থিত সেদিনের সেই স্কুলই আজ- বিখ্যাত বেথুন কলেজ নামে পরিচিত।

 

রবীন্দ্রনাথের কথায় –

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন, ‘তাঁর সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না। প্রতিদিন দেখিয়াছেন, আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না ; আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না ও যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক ও তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আরও এক জায়গায় বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ, যে গুণে তিনি পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগ প্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া – হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে – করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে দৃড়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, আমি যদি অদ্য তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই তবে আমার কর্তব্য অসম্পন্ন থাকিয়া যায়। কারণ , বিদ্যাসাগরের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবার মনে উদয় হয় যে, তিনি বাঙ্গালি বড়োলোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে – তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন । বিদ্যাসাগর জীবনীতে এই অনন্য সুলভ মনুষয়ত্বের প্রাচুর্যই গৌরবের বিষয়। তাঁহার সেই পর্বতপ্রমাণ চরিত্র মাহাত্ম তাঁহারই কৃত কীর্তিকে খর্ব করিয়াছে। তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনো সাহিত্য-সম্পদে ঐশ্বর্য শালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষয় ভাব জননী রূপে মানব সভ্যতার ধাত্রী গণের ও মাতৃ গণের মধ্যে গণ্য হয় – যদি এই ভাষা পৃথিবীর শোক-দুঃখের মধ্যে এক নূতন সান্ত্বনাস্থল, সংসারের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে এক মহত্বের আদর্শলোক, দৈনন্দিন মানজীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে সৌন্দর্যের এক নিভৃত নিকুঞ্জবন রচনা করিতে পারে, তবেই তাহাঁর এই কীর্তি তাহাঁর উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারে। বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। দয়া নহে বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব এবং যতই তাহা অনুভব করিব ততই আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ও বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হইবে এবং বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।”

 

(১৩১৩ সালের ১৩ই শ্রাবণ কলকাতায় বিদ্যাসাগর স্মরণার্থে বাৎসরিক অধিবেশনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণের অংশবিশেষ।)

 

মেরি কারপেন্টার –

 

১৮৫৭ থেকে ১৮৫৯ এই কয় বছরে তিনি প্রায় চল্লিশটি বাংলা বালিকা বিদ্যালয় ও একটি ইংরেজি-বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে বিদেশিনী শিক্ষাব্রতী মিস মেরি কার্পেন্টার ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বাংলায় নারী শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে। বেথুন স্কুলে ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে, প্রথম আলাপেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন মেরি কার্পেন্টার। বিদ্যাসাগরের সাথে নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি ঘুরে দেখতে থাকেন তিনি। হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় মেয়েদের একটি স্কুল দেখে ফেরার পথে গাড়ি দূর্ঘটনার শিকার হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বিদ্যাসাগরকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনেন মিস কার্পেন্টার। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সুচিকিৎসায় সে যাত্রায় সুস্থ হন তিনি।

 

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন দারুণ অর্থকষ্টে ভুগছিলেন তখন বিদ্যাসাগর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একদিন এক মাতাল বিদ্যাসাগরের কাছে এসে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। বিদ্যাসাগরের সোজা উত্তর, তিনি কোন মাতালকে সাহায্য করবে রাজি নন। তখন ঐ মাতাল জানালো যে বিদ্যাসাগর তো মধুসূদনকে সাহায্য করেন ! কিন্তু মধুসূদনও তো মদ খান । তখন বিদ্যাসাগরের জবাব ছিল, ”তুমি ওর মতো ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখে আনো। তোমাকেও সাহায্য করব।”

 

(চলবে)

 

#তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর- প্রসূন কাঞ্জিলাল

বিদ্যাসাগর- বিহারীলাল সরকার বিদ‍্যাসাগর স্মৃতি- বিশ্বনাথ দে

বিদ‍্যাসাগর প্রসঙ্গ- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

আকাশ ইন্টারনেট।

 

*শৌভিক* লেখক পরিচিতি : 

জন্মস্থান হাওড়া জেলার কদমতলা। বর্তমানে নিউটাউন কলকাতায় বসবাস। একসময় ছাত্র আন্দোলন ও কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েছিলেন। পূর্ব ভারতের একটি সুপ্রাচীন বিখ্যাত রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারী হিসাবে কর্মরত।

কৈশোরে কাল থেকেই সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার টানে লেখালেখির অভ্যাস। গ্রাম বাংলা তথা শহর কলকাতা ও প্রবাসের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ রম্যরচনা গল্প – কবিতা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিগত প্রায় আট বছর ধরে সুনামের সাথে। নিজের জীবনের অনুভূতির কালি তে কলম ডুবিয়ে অক্ষরের ইমারতে গড়া তার প্রথম প্রকাশিত বই “প্রিয়ভাষিণী” র জন্য লেখক কবি শৌভিক ইতিমধ্যে বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত নাম। পরবর্তী কালে সেই ধারা বজায় থেকেছে তাঁর “কোজাগরী” ও “চন্দ্র গ্রহণ” বই দুটিতেও। কিশোর কিশোরীদের জন্য লেখক শৌভিকের আন্তরিক প্রয়াস, তার চতুর্থ বই – “সোনাই” যা আসন্ন আন্তর্জাতিক কলকাতা বই মেলায় প্রকাশ হতে চলেছে। বিখ্যাত বাঙালি মনিষীদের ওপর লেখকের গভীর অধ্যাবসায় ও তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ – যা ধরাবাহিক আকারে প্রকাশিত হতে চলেছে অনলাইন কাব্যপটে, আশাকরা যায় পাঠক মননে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।

লেখক: শৌভিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact for Advertisers, Readers and Writers : email: info@kabyapot.com Whatsapp: 8240042145