Spread the love

সোনালী সুন্দরী
সৈয়দ খুকুরানী
দূর্গামাকে আমার গাঁয়ের লোকেরা বলে সোনালী সুন্দরী। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি গাঁয়ে একচালার মধ্যে দূর্গামায়ের সংসার । দূর্গার আগমনে ঘরদোর ঝাড় পোঁচ হয়। উঠোন লেপা, আল্পনা আঁকা এসব পুরানো রীতি।
দু-একটি হাতে গোনা পুজো।সে রকম কোনো আড়ম্বর নেই । ঢাক আছে, কাঁসি আছে , পুরোহিতমশাই আছে ।
আর পাড়ার বয়স্ক থেকে শিশুর আগমন। লোক কুটুমের যাতায়াত , এ-গাঁ থেকে ও-গাঁ।
মণ্ডপ জুড়ে থাকে মিলনের অন্তরঙ্গতা।
সে ছবি পাল্টেছে আজ । চটকদার আলো , গান-বাজনা, ডিজে, মাইক।
কিছুটা ঢাকা পড়েছে সেই অন্তরঙ্গতা। ফিকে হয়েছে ভালোবাসা, স্নেহ , মায়া , মমতা। শ্রদ্ধা আর সম্মান পাওয়া মানুষ গুলো এখন দূরে চলে গেছে। আগের সেই মধূর ছবিগুলো আজ স্মৃতি হয়ে গেছে।
এক বছর পর মা দূর্গা ছেলে মেয়ে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি একাই চলে আসেন।
শিব থাকেন কৈলাসে।
মায়ের আগমনে আবাল বৃদ্ধবনিতার ভীড়।
সেবারের দূর্গাপূজায় আমি শিলিগুড়িতে। মনটা গাঁয়ের জন্য কেমন করতো।
কর্তার পুলিশের চাকরি। তার সঙ্গ পাওয়া দায়। কতো সখ যে শুকনো ফুলের মতো ঝরে গেছে। একাই হাঁটা , একাই চলা, একাই মনে-মনে কথা বলা।
ঐ সময় পুলিশের উচ্চপদস্থ বিশিষ্ট অফিসার সম্মানীয় লেখক সাহিত্যিক নজরুল ইসলাম সাহেব নর্থবেঙ্গলে পোষ্টিং ছিলেন।
আমি শুনেছিলাম উনার লেখা ” বকুল” ভূমিপুত্র “র কথা।
উনি আমায় বলেছিলেন , তুমি যদি একজন লেখিকা হিসেবে আমার কাছে আসো , সবসময় এসো। তোমার অস্ত্র তোমার হাতে আছে । সেটাকে শান দিও। লিখে যেও। নিজেকে অতো অসহায় ভেবো না।
স্বামীর কাছে একটা ছোট্ট অনুরোধ ছিল , আমাকে একবার পুজো দেখাতে নিয়ে যাবে ,
উনি বলেছিলেন , পূজার কটা দিন আমাদের সব পুলিশদের ইমার্জেন্সি ডিউটি থাকে। যাতে জনসাধারণ কোনো অসুবিধায় না পড়ে। আমি অভিমানে নিশ্চুপ হয়ে গেছিলাম। পূজার সময় সবাই আনন্দ করে , ঘুরে, আর আমি?
আমার স্বামীর এক নিকট আত্মীয় আমায় বলেছিলেন, মুসলমান এর মেয়ে হয়ে ঠাকুরের কি দেখবে ?
আমার বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে ছিলেন, মা তোমার স্বামীর তো আর পাঁচজনের মতো ডিউটি নয়। তোমার সামান্য ত্যাগ অনেক জনসাধারণের উপকারে আসবে।
মা দূর্গা তো একাই ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে।
তুমিও একটা রিকশা করে পূজা দেখে এসো।
বাবা বলেছিলেন , শুধু তো ঠাকুর নয় , আলোকসজ্জা, প্যাণ্ডেল সব মিলিয়ে বাংলার বিরাট আয়োজন, বাঙ্গালীর সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয় এই পূজাকে কেন্দ্র করে। তুমি যাও দেখে এসে নিখুঁত ভাবে লিখে ফেলো , ছবি আঁকার অনেক উপকরণ পেয়ে যাবে।
স্বামীর আত্মীয়টি বললেন রজ্জু বেশি ছাড়তে দেওয়া ভালো নয়। মুঠির ভিতর রাখতে হয় মেয়েদের।
আমি আমার বাবার কথায় , আমার সন্তানকে নিয়ে রিকশা করে, শিলিগুড়ি দেশবন্ধু পাড়া , হাকিম পাড়া, হাতি মোড়, মহাবীরস্থান, গেট বাজার, খালপাড়া, থানার মোড় , ভেনাস মোড়ে বিভিন্ন জায়গায় পূজা দেখে আসি।
শুধু তো মূর্তি নয়। কী নিখুঁত কাজ। কত কারিগরের পেটের সাশ্রয়। এসব আমি কাউকে বোঝাতে পারিনা। আমার মা-বাবা শুধু আমার মনের কথা বুঝতে পারতেন।
কী বৃহৎ শিল্পকলার মাধ্যমে একজন আর্টিস্ট নিজের শিল্পকে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পায়। পূজাকে কেন্দ্র করে কতো মানুষের সাথে মানুষের অন্তরঙ্গতা হয়। এক মহামিলনের মেলায় আমরা হারিয়ে যাই।
সেই ছবি জীবনভোর আমাদের হৃদয়ে গাঁথা থাকে বইয়ের পাতার মতো। পাতা উল্টালেই ভেসে ওঠে সেসব স্মৃতিগুলো।
বলাবাহুল্য , সেবারই শিলিগুড়ি মিলনপল্লী পূজা কমিটি কালচারাল প্রগ্রামের একটি বিশেষ দায়িত্ব আমায় দিয়েছিলেন। সেই দায়ভার পালনে , পূজার কয়েকটা দিন আমার অত্যন্ত ব্যস্ততা ও আনন্দের সাথে কেটেছিল।
একবারও মনে হয়নি আমি মুসলিম। মনে হয়েছিল আমরা সবাই এক জাতি এক প্রান। আমরা মানুষ। সব যেন একাকার হয়ে গেছিলো। পঞ্চমী থেকে দশমী কটা দিন কিভাবে যে কেটে গেছিল বুঝতেই পারিনি। মা-দূর্গার এবার কৈলাসে স্বামীর ঘরে গমন। সিঁদুর দান। মাকে বরণ। চারিদিকে বিষন্নতা। দূর্গামাকে ট্রাকে তোলা হোলো। বাবা ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে পিঠে হাত দিয়ে বললেন, যা মা বিসর্জন দিয়ে আয়। ছলছল চোখে আমি বললাম , লোকে কী বলবে । বাবা বললেন উঠে পড় মা গাড়িতে। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে ট্রাকের পিছনে উঠে পড়লাম। উল্লাস পটকা , ঘাট, কাঁসরে মায়ের বিদায়ী শোভাযাত্রা হিলকার্ট রোড ছাড়িয়ে , মহানন্দার দিকে এগিয়ে চললো। বিকেলের সূর্য ঢলে পড়ছিল মহানন্দার বুকে। সবাই বলে উঠলো দুগ্গা মাই কি জয়।ঢাকির কাঠি নিস্তব্ধ হোলো।কাঁসর ঘন্টা বন্ধ হোল। দূর্গা মা ভেসে চললেন মায়ের বাড়ী থেকে ছলছল চোখে স্বামীর বাড়ি। সব মেয়েরাই এভাবেই দূর্গামায়ের মতো চোখে জল নিয়ে ফিরে আসে স্বামীর সংসারে। সবাই মনমরা। মন খারাপের কলস ভরা হোল শান্তিজলে। সূর্য”টা আস্তে -আস্তে মহানন্দার বুকে মাথা রাখলো। বিসর্জনের মিষ্টি আর শান্তিজল সবার মঙ্গলকামনা করলো। জনহীন শূন্য মিলনপল্লী কোয়ার্টারের মাঠটা যেন শোকে বিহ্বল।মনে পড়লো আমার গাঁয়ের কথা। সেই নির্জনতার কাঁচ-কালো পুকুরের জলে সোনালী সুন্দরী ভাসানের কথা।
শূন্য অবিন্যস্ত প্যাণ্ডেলের দিকে চেয়ে আপন মনে শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
” চারকোনা পুকুরটি টলমল করে,
সোনালী সুন্দরী জলে ডুবে মরে” ।

কলমে : সৈয়দ খুকুরাণী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact for Advertisers, Readers and Writers : email: info@kabyapot.com Whatsapp: 8240042145